Friday 2 December 2016

দ্বৈধ

আমি দ্বিধাণ্বিত  ভেংগে চুরমার হওয়ার উপক্রম এক পুরুষ।লোকে আমাকে বীর পুরুষ বলে আখ্যায়িত করে।আমি হেঁটে গেলে তারা পথ ছেড়ে দাঁড়ায়।আংগুল উঁচিয়ে ফিস ফিস করে বলে বীর'---'।শেষে আমার নামটা জুড়ে দেয়, বলে দেখ কত সাহস,কি দেশ প্রেম,কোন কিছু পরোয়া করে না।কিন্তু ওরা তো জানে না প্রতিমূহুর্তে আমি ক্রমশ ভেংগে পড়ছি।আমি কত অসহায়,মানসিক ভাবে কত দূর্বল,কত সামান্য ,কত গতানুগতিক।

আজ আমি স্বনামধন্য এক যুদ্ধক্ষেত্র ফেরৎ যুবক।রণাংগনে পা হারিয়েছি।সমাজ সংস্কারে ব্যস্ত।বিখ্যাত এক বিদেশী অনুদান প্রাপ্ত সমাজ কল্যাণ সংস্থায় উচ্চ পদে কাজ করি ।কত বারাংগনা, কত যুদ্ধশিশু আমার নেতৃত্বের ছায়ায় শান্তি খোঁজে।তাদের কারও কারও পরিপূ্র্ণ সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি কারও বা আংশিক। সবাই আমাকে ঈশ্বর বা ফেরেশতার আসনে বসিয়ে রেখেছে। নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে কত ধরণের সমস্যা আর কত ধরণেরই না সমাধান। আর সব  কিছুর যে সমাধান করা সবসময় সম্ভব তা নয়।যেমন আমি নিজের সম্যসার সমাধান আজও করতে পারিনি।শ্বেতাংগিনী সহকর্মীনি মার্গারেটা বলে,ওকে দত্তক নিয়ে নিলেই তো পার ?সবই তো তুমি করছ ওর জন্যে। ওর  জন্য তোমার এত ভালবাসা। কিন্তু আমি যে আমার মনের সাথে যুঝে চলেছি নিরন্তর,নিরবধি।ওকে অর্থাৎ বিজয়িনীকে-বিনিকে আমি ভালবাসি।ও এরই মধ্যে পাঁচে পা দিল।কি সুন্দর নজর কাড়া চোখ, মুখ।মায়ের চেহারা যেন কেটে বসানো।চোখের কোল ঘেঁষে তিলটা অবধি ও যেন আইশার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসেছে।

ওর মা আইশা ছিল অপরূপা,তবে খাটো।এ নিয়ে ওর দুঃখের অবধি ছিল না।যতই না বলি দেখ আমিও তো খাটো,আর আমি কি রূপবান? কিন্তু আমাদের সম্পর্ক তো অটুট।আমাদের মানসিক যে সেতু বন্ধন তাতো পলকা নয়। দুর্জয় সাহস আর প্রচন্ড জেদ আমাকে রণাংগনে ঠেলে দিয়েছিলো।কিন্তু সত্যি বলতে আমি খুব কোমল প্রকৃতির ।

এই তো এখন বিনি আমার দুপায়ের মাঝখানে ঢুকে বিড়াল ছানার মত কোলে মুখ গুঁজে আছে।ওর যতক্ষন মন চাইবে ও ততক্ষণই এভাবে থাকবে।বাধা দেওয়ার কায়দা আমার জানা নেই।আমার নাম জানে।বলে তোমার নাম এমন কেন? কেমন?-আমি বলি।এই যে সেলিম।তা খারাপ কি?না কেমন যেন।আচছা পিতা আমার মা কোথায়?ওই যে কমলিকা,সেরিনা,নাজমা,বিজরী ওদের তো মা আছে।আমার নেই কেন?আমি নিরুপায় হয়ে বলি ওদের মাকে কি দেখেছ?কমলিকার মা তো মাঝে মাঝে আাসে-বলে বিনি।জিঞ্গাসা করি বাকি ওদের মা?আসবে,আসবে তো,ওরা বলেছে;চকলেট,আরও অনেক কিছু নিয়ে আসবে,ওদের কোলে বসিয়ে অনেক অনেক আদর করবে। কিন্তু কবে আসবে ওদের মা এর উত্তর ওর সংগীদের যেমন জানা নেই আমারও তেমন  বলার উপায় নেই।আর বিনিই বা কেমন করে জানবে  যে ওদের মায়েরা যে হারিয়ে গেছে জনারণ্যে নতুন জীবনে।তাদের জীবনের এই কালো অধ্যায়  তারা ভোলার চেষ্টায় ব্যাপৃত।আর কেউ কেউ তো আশ্রয় নিয়েছে বারবণিতা পল্লীতে ,আঁকড়ে ধরেছে পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা।আমরা তাদের সমাজে ফিরিয়ে এনে পুর্নবাসিত করতে চেয়েছি কিন্তু বেলোয়াড়ি চুড়ির মতো পল্কা মানসিকতার তারা আর তা পারেনি। বিনির তো এসব বোঝার কথা নয়। আচ্ছা পিতা তুমি তো অনেক কিছু জান।তুমি কি বলতে পার মা আকাশের তারা হয়ে গেল কেন?রীটা(মার্গারিটা) বোধ হয়
এসব জ্ঞান দিয়েছে।

আবার বলে যে সব বাবা খারাপ তারা না থাকাই ভাল।আমি জানি কমলিকা,সেরিনা ওদের বাবা পচা।আমার পিতা ভাল।চোখ ভিজে ওঠে,হায়রে অবোধ শিশু আমার মনে যে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে!আমি কি করে বোঝাই আমি তো ওর পিতা হয়েই থাকতে চাই সারা জীবন কিন্তু মাঝখানে যে একটা কাঁটা সর্বদা খোঁচাচ্ছে।বাবুল মিঞা কেয়ার টেকার অত্র প্রতিষ্ঠানের, বিনি মা-মনিকে আমাকে পিতা বলে ডাকতে শিখিয়েছে।কেন কে জানে!সবই কি আল্লাহ্ বা ঈশ্বরের নির্দেশিত?বা একেবারেই প্রহসন!

সেই যে বলছিলাম আমি ছোট খাট খুবই সাধারণ চেহারার যুবক,বাহ্যিক সৌন্দর্যে কাউকে আকৃষ্ট করার মত কিছু গুণ আমার নেই কিন্তু আজ এত বড় প্রতিষ্ঠানের প্রায় কর্ণধার হয়ে বসে আছি।আমার মতামতের অনেক মূল্য।দেশের তাবৎ বড় বড় মন্ত্রী উপমন্ত্রীদের সাথে আমার ওঠা বসা।অনেকেই জানে আমাকে,ভীষণ কঠিন,কঠোর তবে ন্যায়পরায়ণ একটি মানুষ বলে।ক্ষুরধার আমার বুদ্ধিতে অনেক সম্যসার চমৎকার সমাধান করি ক্ষণিকে।

আমার আর আইশার দেখা হওয়া একটা দৈবাৎ ঘটনীয় ঘটনা।আমার বোন মিলি আর ওরা কয়েক বান্ধবী -অন্জলি,আইশা,খালেদা,টুম্পা,রেমা একসাথে ঘুরে বেড়াত।এমনই একদিন ওরা কয়েক বান্ধবী মিলে গোল হয়ে এনামেলের সাদা বাটিতে ক কি যেন খা্চ্ছিল।হঠাৎ মাথায় কি দুর্বুদ্ধি চাপল আইশার হাত থেকে বাটিটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলাম।প্রায় বিদ্যুের গতিতে আইশা দাঁড়িয়ে আমর দিকে তাকিয়ে বলল নিলেন কেন?ওর চোখের দৃষ্টির সাথে আমার চোখের দৃষ্টির মিলন ঘটল না কি ঘটল জানিনা আমার শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ স্ফুলিংগ প্রবাহিত হলো।আমি তখন মাত্র অষ্টম শ্রেণীতে আর আইশা চতু্র্থ শ্রেণীতে।বলতেও লজ্জা হয় এই বয়সে প্রেম--ইঁচড়ে পাকা কোথাকার।কিন্তু অঘটনপটিয়সী রসিক কিউপিড তো ততক্ষনে দূর্ঘটনা যা ঘটানোর ঘটিয়েই দিয়েছে।আইশা তো তখন নিতান্তই বালিকা।তবে আমার তো ভালো হোক মন্দ হোক যা হবার হয়েই গেছে। ঘটনা এখানেই থেমে গেলে আজ বিনিরও জন্ম হত না আমিও এই দুর্বিষহ জীবন যাপন করতাম না। ভবিতব্য কি খন্ভানো যায়!

এরপর থেকেই আইশা যখন তখন আমদের ঘরে আসতে শুরু করল।অলক্ষ্যে দুটো বরই কি একটু আচার টেবিলে রেখে যেত।কখনও বা পেছন থেকে এসে পিবিয়েঠের পর কচি হাতের আচমকা একটা কিল দিয়ে চলে যেত।এই লুকোচুরির খেলা চলল বহুদিন।ক্রমে আমি কৈশোর হতে যৌবনে পা দিলাম ।আইশাও ততদিনে  একটি অপরূপ কিশোরী  হয়ে উঠেছে।আমাদের এই বাঁধ ভাংগা প্রনয় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল।তবে বোধ করি যুগ এবং পারিবারিক রক্ষণশীলতা শিক্ষার কারণে আমাদের সর্ম্পক কখনও সীমা লংঘন করেনি।ইতিমধ্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ,এ পড়ছি আর আইশা প্রথম বর্ষ বি,এস ,সি পড়ছে।

অফিসে কাজ করছিলাম,নজর পড়ল দরজার দিকে।দেখি বিনি উঁকি দিচ্ছে সভয়ে।আমি বললাম-এসো বিনি কিছু বলবে।পিতা একটা পুতুল কিনে দেবে।ওকে কিনে দেওয়া মানে ওর সংগী সাথীদের সবাইকে একটা করে কি নে দেওয়া।বিনির পেছনে আড়ালে পঞ্চাশোর্ধ বাবুল মিঞা দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারি।

এরপর দেশ জুড়ে পাকিস্তানী আর্মির নর হত্যা আর ধ্বংস  যজ্ঞ শুরু হয়েছে।
স্থির করলাম না ভুল হলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম ভারতে পলাব এবং যুদ্ধের ট্রেনিং নেব পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথ সম্মুখ সমরের জন্য।আইশা জানত কিন্তু কোনরকম বাধা দেয়নি ।তবে সে জেদ ধরল  বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে।আমি যতই তাকে বুঝাই যুদ্ধক্ষেত্র এক অনিশ্চিত জায়গা হত আমর মৃত্যুও হতে পারে।না সে অনড়।অবশেষে যে রাত্রে আমরা পালাব সেই দুপুরে আমরা বিয়ে করলাম এক কাজী অফিসে।আমর বোন মিলি,বান্ধবী খালেদা আর আমার দুই বন্ধু সাহেদ আর পিয়ারের সাক্ষীতে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।দিনে দুপুরে আামাদের বাসর হলো সাহেদের বাসায়।ওর বাবা মা ,ভাই বোন ভয়ে গ্রামের বাড়ীতে।

রাত নটার দিকে আমি,সাহেদ,পিয়ার আরও দুটো ছেলে পালালাম বাড়ী থেকে।আমাদের  ওপারে পৌঁছাতে লাগল প্রায় দিন পাঁচেক।প্রায় দিন পনের পর খবর পেলাম যে রাতে আমরা পালালাম সেই রাতেই আমাদের বাড়ীসহ আরও কয়েকটি বাড়ীতে পাক আর্মি ও স্থানীয় বদমাশরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আরও খবর পাই বাধা দেওয়ায় আমার বাবা মা ও বোন টা প্রাণ হারায়।ভাইটা পালিয়ে বেঁচেছিলো কিন্তু স্বাধীনতার পর সে হয় হাইজাকার ও ডাকাত।এবং পরে তৎকালীন আইন রক্ষাকারি বাহিনীর হতে মারা পড়ে। শুনতে ও বলতে খুব নিষ্ঠুর  হলেও ওর মৃত্যুতে আমি খুব স্বস্তি ও শান্তি পেলাম।এরকম কুলাংগার বেঁচে থাকার চেয়ে মারা গেলেই তো সংসার,সমাজ , দেশ ওপৃথিবীর জন্য মংগল।ওর মৃত্যুর পর আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম।যে ভাইটাকে এত ভালবাসতাম, যাকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে আগানে বাগানে ঘুরেছি,যে প্রায়ই আমার হাতের চটকানা খেত আমার ডাক টিকিট চুরির দায়ে  সে ভাইটা চলে গেলে আমি হয়ে গেলাম নিসংগ,বিরাট এক ধ্বস নামল আমার মানসিক অবস্থায়। ঠিক এ সময়টাতেই দেখা পেলাম বিনির।আইন রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকে প্রস্তাব দিয়েছিলো আমি একটু সম্মতি দিলেই ভাইটিকে দেশ থেকে পালানোর ব্যবস্থা তারা করে দেবে,তবে পরিবর্তে আমাকে কয়েকটি  অন্যায় শর্ত মেনে নিতে হবে।শর্তও মানতে পারিনি প্রাণের দোসর ভাইটিকেও বাঁচাতে পারিনি।

বিনিকে পেয়ে আমার হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেলো।আমার আলোড়িত হৃদয়ে তোলপাড় ফেলে দিল বিনির কৃষ্ন কালো দীর্ঘ চক্ষু পল্লব।কত শক্তি ধরে তার বন্কিম ভ্রু-যুগল।বিনি যেন আমায় নতুন জীবন দিল।কিন্তু সেই সাথে যুক্ত হলো দ্বৈধতা।এক নতুন আমি,নতুন সেলিমকে আমি উপলব্ধি করলাম।অনেকে আমায় আড়ালে ডাকে অবধূত হলে। কিন্তু কত হীণ আমি, কতই না নগন্য তার তো সাক্ষী আমি স্বয়ং।
আমি তখন জার্মানীতে।যুদ্ধক্ষেত্রে হারানো পায়ে গ্যাংগ্রীন ধরে।নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার,ভারত সরকার ও জার্মানীর বাংলাদেশী জনগোষ্ঠির সহায়তায় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে জার্মানীতে ।ফিরলাম প্রায় দেড় বছর পর।এসেই খোঁজ করলাম আইশার।  জুন মাসের সেই কালরাতে পাক সেনা এবং তাদের সহচরেরা আমাদের এলাকা থেকে আইশা,খালেদা আরও কয়েকটি মেয়েকে বাংকারে তোলে, তাদের উপর অমানুষিক,বর্বর অত্যচার চালায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মেয়েগুলি শারীরিকভাবে মুক্তি পেলেও তাদের মানসিক বৈকল্য থেকে মুক্তি ঘটেনি ।সন্তান প্রসবের পর আইশা আত্নহনন ছাড়া আর কোন পথ পায়নি।খালেদা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আজও মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এরপর দেখা পাই বিনির।আইশার দেওয়া নাম বিজয়িনী যার সংক্ষিপ্ত রূপ বিনি।আইশা বিয়ের পর বলেছিলো ওর কন্যা সন্তান হলে নাম রাখবে বিজয়িনি। মনের এই অবস্থায় বললাম,হে বিভু আমায় শক্তি দাও,।মনের এই দ্বন্দ থেকে মুক্তি দাও।হোক না কেন যে কেউ ওর পিতা আমি বা শয়তানের দোসর,কিন্তু  আমার আইশার রক্ত বইছে ওর ধমনীতে।হে বিভু মনের এই দ্বৈধতা থেকে মুক্তি দাও।দেখাও আমায় আলোর পথ,মানবতার পথ,সংস্কারহীনতার পথ।জয় হোক মানবতার-আমার সন্তান বিনিকে যেন দিতে পারি মাথা উঁচু করে বাঁচার ছাড়পত্র।