Showing posts with label বাংলা ছোট গল্প. Show all posts
Showing posts with label বাংলা ছোট গল্প. Show all posts

Tuesday, 24 May 2016

পরীর দেশে এনা এবং মিরা

পরীর দেশে
Some rights reserved. This work is licensed under a  Creative Commons Attribution 3.0 License.
এনা আর মিরা ওরা দু'বোন। এনার বয়স পাঁচ আর মিরার মাত্র তিন। ওদের দুটিতে ভরি ভাব.. গলায় গলায় ভাব
যাকে বলে আর কি! এনা সব সময় নিজের হাতের কচি মুঠোয় তার চেয়ে নরম মিরার মুঠিটা শক্ত করে ধরে রাখে।
যেখানেই যায় দু'বোন একসাথে যায়। একজনের হাসিতে আর একজন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। যখন কাঁদে তখন দু'জনই  শুরু করে।

ওদের বাড়ির পাশেই থাকত ওদের এক চাচি। চাচির ঘরের দরজার পাশেই ছিল চমৎকার ঝোপালো একটা বেলি ফুলের গাছ। ছোট ছোট সাদা ফুলে ছেয়ে থাকত। আরও ছিলো সন্ধ্যামণি  ফুল। গাঢ় গোলাপি রংএ শেষ বিকেল ঝলমলিয়ে হেসে উঠত। ওরা দুটি বোন অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখত। কচি কচি সদ্য মেলা পদ্মআঁখি যা দেখে তাতেই  চমৎকৃত হয়।

ওরা দু বোন প্রতি বিকেলে ফুল গাছগুলোর কাছে এসে দাঁড়ায়। সুরভিত হতে ওদের বেশ লাগে....

প্রতিদিন ওদের অবাক চোখে চেয়ে থাকা দেখে চাচির একটু রগড় করতে মন চাইল। চাচি বললেন, "তোমরা বুঝি ফুল খুব ভালোবাসো! বেশ একটূ বড় হও তোমাদের বাগান করা দেখিয়ে দেব। আচ্ছা, তোমরা কি কখনও পরী দেখেছ? জানো  এই উঠোনে নিশুতি রাতে পরী আসে"
এনা প্রশ্ন করে ওঠে, "সত্যি!"
চাচি বলেন "সত্যি বৈকি। আর আজ তো পূর্নিমা ওরা তো আরো বেশি আসবে দলে দলে। তোমরা তোমাদের জানালায় বসে থেকে দেখতে পাবে।"  হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে এনা জানায় সে তাই করবে।

তারপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ওদের মা ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ওরা দুজন বিছানায় অপেক্ষা করতে থাকলো কখন জানালা গলিয়ে চাঁদের আলো আসে বিছানার উপর। আস্তে আস্তে ওরা বিছানা ছেড়ে জানালায় গিয়ে বসলো। জানালার গরাদে হাত রেখে এনা বলল মীরা কে শুনতে পাচ্ছিস 'ওরা আসছে'! মীরা কি ছাই এত কিছু বোঝে! তবুও ওপরে নিচে দুবার মাথা নাড়ে।
সত্যি সত্যি একটা পরী এসে নাম চাচির উঠোনে। ওরা তো মহা খুশি। তারপর ওরা দুজনে পা টিপে টিপে দরজা খুলে বাইরে এসে গুটি গুটি পায়ে ফুল গাছের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। এক এক করে অনেক কজন পরী এসে নামল ফুল বাগানে। কি সুন্দর তারা দেখতে। সোনালী বা কালো লম্বা রেশমের মত ঢেউ খেলানো চুল। কারো চোখের রং নীল কারোর বা কালো। কি তাদের চেহারা। আর পাখা সে যে কত রঙের, আর কত বাহারি নকশার। একটা বাচ্চা পরী এনা দের কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল, "এই তোমরা কারা গো এখানে দাড়িয়ে আছ?"

এনা বলল, আমি এনা আর এ আমার ছোট বোন মিরা। মিরা তো ততক্ষনে মুখ লুকিয়ে ফেলেছে এনার পেটের কাছে আর দুহাত দিয়ে বোন কে জড়িয়ে ধরেছে। পরী মেয়ে টি তার  মাকে ডেকে বলল দেখো মা দুটি ফুটফুটে খুকী। ছোট এনা মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তি জানালো। না না আমি মোটেই খুকি নই। আমি কত্ত বড় হয়ে গেছি, আমার ছোট বোন মিরা এখনো খুকি। পরী বললো তা যাই হোক চল আমরা এখন খেলি। পরীদের হাতে গলায় কানে সব ফুলের গয়না। কি সুন্দর তাদের তাদের রং আর কি সুন্দর গন্ধ। ওরা সবাই নাচছে, গাইছে, হাসছে লুটোপুটি খাচ্ছে। কি হাসি! কি আনন্দ তাদের! শিশু পরি দুটো ঘুমিয়ে পড়ল ফুল গাছের তলায়।

এনা আর মিরা ওদের সাথে খেললো গাইল, নাচলো।

এদিকে রাত গড়িয়ে সকাল হব হব করছে। চাঁদ মধ্য আকাশ থেকে একটু পশ্চিমে হেলেছে। পরীরা বলল চল এবার যাওয়া যাক। সুন্দরী মা পরী জিজ্ঞাসা করলো, 'এনা যাবে নাকি আমাদের সাথে আমাদের দেশে। এনা একটু ইতস্তত করলে মা পরি বলল ভয় কি আমি তো আছি!' মা পরীটা আরো বলল 'তোমাদের কে আমার খুব পছন্দ হযেছে, তাই বললাম। আমরাই নিয়ে যাব সাথে করে আবার সকাল হবার আগে মা জেগে ওঠার আগেই তোমাদের আবার নামিয়ে দিয়ে যাব। তোমাদের মত লক্ষ্মী মেয়ে আর হয়ই না। যাবে তো চল, রাত আবার পেরিয়ে যাচ্ছে।'

এনা মিরার দিকে চাইল। মিরার  দু চোখে ভয়। এনা বোনকে সাহস যোগালো ভয় কি আমি আছি না! সত্যিই তো তাই ওর বোন আছে না! ওর কত সাহস মাকে ছেড়ে স্কুলে যায়। এনা পরীদের বলল 'তবে যাই চল, আমাদের আবার পৌছে দিতে হবে কিন্তু।'

দুটো মা পরী এনা আর মিরার  হাত ধরল।

প্রথমে জোড়া পায়ের দুটো ছোট লাফ এর সাহায্যে একটু উপরে উঠলো। তারপর উড়তে উড়তে দূর আকাশের দিকে উড়ে যেতে থাকলো। নিচে তাকিয়ে এনা দেখল ওদের বাড়ি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। আবছা আবছা দেখতে পাওয়া মসজিদ, মন্দির, পুকুর একসময় এক্কেবারে মিলিয়ে গেল। মিরা জোরসে এনার হাতটা জড়িয়ে ধরল। এনার ও একটু ভয় করছিল বই কি। পরীরা ওকে সাহস যোগালো।

ওরা উড়ছে তো উড়ছেই.. এবার এলো ওরা মেঘের রাজ্যে। পেঁজা তুলোর চাইতেও নরম শীতল সে মেঘগুলো। ওদের মা যখন ওদের কপালে আলতো করে ঠোট ছোঁয়ান ঠিক তেমনি অনুভূতি।  

পরী মা ওদের দুজনকে দু হাতে বসিয়ে নীল তারার দিকে উড়িয়ে নিয়ে চলল। মেঘএর ফাঁকে ফাঁকে ওরা এবার উড়ছে। এবার শুধুই নীল আকাশ। শেষে ওরা পৌছালো পরীদের রাজ্যে। কি সুন্দর! কি সুন্দর! ওদের দু বোনের চোখ ছানা বড়া হয়ে গেল। কি সুন্দর ঘর বাড়ি! পরীদের ঘর গুলো যেন কেমন কাঁচের মত স্বচ্ছ.. ফুল লতা পাতা আকা। একজায়গায় দেখল রংধনু তার সাতটি রং নিয়ে উপস্থিত। বাচ্চা একটা পরী বলল ওটা রাজবাড়ির তোরণ। পেছনেই আছে রাজপ্রাসাদ।

ওরা মা পরীর হাত থেকে নেমে পড়ল। দেখল শিশু পরীরা খেলে বেড়াচ্ছে। তারা প্রজাপতি আর ফড়িং এর সাথে লুকোচুরি খেলছে। হরিন ছানা ঘাস খাচ্ছে নির্ভয়ে। পুকুরে হাঁস চরছে আর পরীরা সাঁতার কাটছে। পরীরা ওদের মধু খেতে দিল পদ্ম পাতায় করে। এনার মন চাইছিল সেও একটু ওদের সাথে খেলা করে কিন্তু মা পরী বলল, 'এবার চল তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।'  ওরা আবার উড়ে চলল।

খুব সকালে সূর্যের প্রথম কিরণ ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই এনা আর মিরার মা বিছানায় উঠে বসলেন। চমকে উঠে লক্ষ্য করলেন এনা আর মিরা বিছানায় নেই। অবশেষে খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল ওদের খুব প্রিয় ফুল গাছের তলায়। হাত ধরা ধরি করে ওরা ঘুমুচ্ছে..

Tuesday, 3 May 2016

জয়তু মেধা.. জয়তু অধ্যবসায়

মেয়েটির নাম তারা। ওর নাম রেখেছিলো ওর মা। জন্মের সময় ও জন্মেছিলো ভূষুনডি কাকের মত কালো রং নিয়ে। তা নিয়ে কি আর সালমার কম দুঃখ ছিল। পোয়াতি সালমাকে তো কবেই তার স্বামী আর শাশুড়ি আরাম করার নামে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাপের বাডি। তা সালমা বিয়ালো  কিনা একটা কাউয়ার ছাও। জমিলা (সালমার মা) বলে,ওই সালু তোর মাইয়ারে আঁই ডাকতাম শেফালি করি। সালমা আঁতকে উঠে বলে, 'ন মা ন, আন্নে হেতিরে ডাকিয়েন নয়নতারা কই। আঁদাড়ে -পাঁদাড়ে জন্মায় কোন যতন লাগে ন। আঁর মাইয়া তো কিল-গুঁতা খাই বড় অইব হের লাগি হেই নামই ঠিক'।

তো সত্যি কিল-গুঁতা খেয়ে না হোক অভাব অনটনে নয়নতারা ওরফে তারা বড় হয়ে উঠতে থাকল এক বস্তিতে। জন্মসূত্রে যে ওর বাবা সে কোনদিন তাকে  দেখতে পর্যন্ত আসেনি। এখনও সালমা আরাম করছে! মানুষ  নয়নতারা, নয়নতারা ফুল গাছের মতই অভাব অনটনেও দিব্যি বেঁচেও থাকল আর বড় হয়ে উঠতে লাগল। সালমার দূরদর্শিতা বারবার প্রমানিত হতে লাগল। সালমা আর এখন মকবুলের সেই কলা বৌ টি হয়ে নেই! সে এখন এক সংগ্রামী  নারী। তার অনুভবে তার স্বামী মকবুল কেন কোন মকবুলই আর অনুরণন তোলে না। কঠিন বাস্তবতার পেষণে জীবনের অন্য সব চাওয়া এখন গৌণ, মৃত। সালমার রঙ্গিন স্বপ্ন এখন পল্লবীত তার একমাত্র সন্তান নয়নতারাকে ঘিরে। নয়নতারা নিয়মিত ইস্কুলে যাচ্ছে। সালমার স্বপ্ন আর প্রতিজ্ঞার প্রতিফলন এখন নয়নতারায়। সালমার মুকুলিত ইচ্ছায় জল ঢালছে অবহেলিতা নয়নতারা।

সালমার মা গতায়ু। বেঁচে থাকলে সালমা বলতে পারত, 'আন্নে দেহেন মা, আঁই নয়নতারারে শেফালির লাহান ঝরি পড়তে দেই  ন। হে বাঁচি রইছে নয়নতারা ফুলের লাহান। আ্ননের দুয়ায় আঁর তারা লেহা ফড়া হিখি তালগাছের হমান বড় হইব'।

নয়নতারা ইসকুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। তার মা সালমা বাসায় কাজ করে। বেগম সাহেবা বলেন, 'সালমা তুই পুরোনো কাগজ আর শিশি বোতল গুলো লিয়ে যা তো। আর কোনো অসুবিধা হলে তারাকে নিয়ে এসিস, পড়া বুঝিয়ে দোবো'। কাগজগুলো খুপরি ঘরে নিয়ে এসে জমা করে সালমা। বেশ কিছু জমে গেলে সে গুলো বিকরি করে তারার খাতা পেনসিলের খরচ চালায়। মকবুল আর মকবুলের মায়ের অবজ্ঞা সালমাকে দিয়েছে প্রচন্ড গাত্রদাহ।  সে কিছুতেই হার মানবে না। তা কাগজ আর মাগাজিন পেয়ে আরও একটা উপকার হয়েছে তাদের। অবসর সময় বসে মা-বেটিতে ওগুলো পড়ে আর ছবি দেখে। কখনও বা মুদির দোকানি জলিলের জন্য বানায় কিছু ঠোংগা। তাতেও দুটো পয়সা হয় বৈকি।

তারার মোটে দু প্রস্থ কাপড়। এই দুই প্রস্থ কাপড় সে পরিষ্কার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরে। সেদিন সব জামা কাপড় ধুয়ে শুকোতে দিয়ে সে একটা ছেঁড়া ত্যানা পরে ঘরের কোণে লুকিয়ে বসেছিলো। আকাশে মেঘ জমেছে মা ফেরেনি যে কাপড়গুলো এনে দেয়। খবরের কাগজ আর বই পড়ায় বুদ্ধি তার এখন যেন ঝকঝকে তলোয়ার! সে অনেকগুলো খবরের কাগজ লম্বাটে করে ভাঁজ দিয়ে একটা দড়িতে সার সার করে সাজিয়ে কোমরের সাথে বেঁধে নিলো স্কার্টের মত। তারপর আর একটা কাগজে মাথা গলানোর মত করে কেটে, পরে নিয়ে কোমরের কাছে বেঁধে নিলো মাথার লাল ফিতে দিয়ে। জামবুরার খোসাটা মাথায় দিয়ে সে বেশ পরিশীলিত ভাষায় চীৎকার করে বললো, 'এই হনুফা দেখ কি পরেছি। তার বুদ্ধিদিয়ে সে তার দৈন্যতা আর সবার উপহাসকে বুড়ো আংগুল দেখাল। আর ঠিক তখনই রুকসানার চোখে পড়ে গেল তারা। রুকসানা এসেছিলো বস্তিতে কিছু সামাজিক কার্যক্রম নিয়ে। তিনি একটি নামকরা বিজ্ঞাপন সংস্থার মালিক। তিনি তারার  ছবি নিলেন আর ছাপলেন 'অনিন্দিতায়'। খুব কাটতি হলো সাময়িকিটির। রুকসানা ঠকালেন না তারাকে। নিয়মিত তাকে কাজ দিলেন এবং পড়াশোনার খরচ দিয়ে তাকে গড়ে তুললেন। তারা আগিয়ে যাচ্ছে, সালমা আজ সফল। ওরা আজ সোচ্চার 'পৃথিবীতে মকবুল ছাড়াও বেঁচে থাকা যায়'। জয় তারা, জয় সালমা। জয়তূ মেধা, আর  জয়তু অধ্যবসায়। বিজিতার কনক মুকুট আজ ওদের শিরে।