Tuesday 3 May 2016

জয়তু মেধা.. জয়তু অধ্যবসায়

মেয়েটির নাম তারা। ওর নাম রেখেছিলো ওর মা। জন্মের সময় ও জন্মেছিলো ভূষুনডি কাকের মত কালো রং নিয়ে। তা নিয়ে কি আর সালমার কম দুঃখ ছিল। পোয়াতি সালমাকে তো কবেই তার স্বামী আর শাশুড়ি আরাম করার নামে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাপের বাডি। তা সালমা বিয়ালো  কিনা একটা কাউয়ার ছাও। জমিলা (সালমার মা) বলে,ওই সালু তোর মাইয়ারে আঁই ডাকতাম শেফালি করি। সালমা আঁতকে উঠে বলে, 'ন মা ন, আন্নে হেতিরে ডাকিয়েন নয়নতারা কই। আঁদাড়ে -পাঁদাড়ে জন্মায় কোন যতন লাগে ন। আঁর মাইয়া তো কিল-গুঁতা খাই বড় অইব হের লাগি হেই নামই ঠিক'।

তো সত্যি কিল-গুঁতা খেয়ে না হোক অভাব অনটনে নয়নতারা ওরফে তারা বড় হয়ে উঠতে থাকল এক বস্তিতে। জন্মসূত্রে যে ওর বাবা সে কোনদিন তাকে  দেখতে পর্যন্ত আসেনি। এখনও সালমা আরাম করছে! মানুষ  নয়নতারা, নয়নতারা ফুল গাছের মতই অভাব অনটনেও দিব্যি বেঁচেও থাকল আর বড় হয়ে উঠতে লাগল। সালমার দূরদর্শিতা বারবার প্রমানিত হতে লাগল। সালমা আর এখন মকবুলের সেই কলা বৌ টি হয়ে নেই! সে এখন এক সংগ্রামী  নারী। তার অনুভবে তার স্বামী মকবুল কেন কোন মকবুলই আর অনুরণন তোলে না। কঠিন বাস্তবতার পেষণে জীবনের অন্য সব চাওয়া এখন গৌণ, মৃত। সালমার রঙ্গিন স্বপ্ন এখন পল্লবীত তার একমাত্র সন্তান নয়নতারাকে ঘিরে। নয়নতারা নিয়মিত ইস্কুলে যাচ্ছে। সালমার স্বপ্ন আর প্রতিজ্ঞার প্রতিফলন এখন নয়নতারায়। সালমার মুকুলিত ইচ্ছায় জল ঢালছে অবহেলিতা নয়নতারা।

সালমার মা গতায়ু। বেঁচে থাকলে সালমা বলতে পারত, 'আন্নে দেহেন মা, আঁই নয়নতারারে শেফালির লাহান ঝরি পড়তে দেই  ন। হে বাঁচি রইছে নয়নতারা ফুলের লাহান। আ্ননের দুয়ায় আঁর তারা লেহা ফড়া হিখি তালগাছের হমান বড় হইব'।

নয়নতারা ইসকুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। তার মা সালমা বাসায় কাজ করে। বেগম সাহেবা বলেন, 'সালমা তুই পুরোনো কাগজ আর শিশি বোতল গুলো লিয়ে যা তো। আর কোনো অসুবিধা হলে তারাকে নিয়ে এসিস, পড়া বুঝিয়ে দোবো'। কাগজগুলো খুপরি ঘরে নিয়ে এসে জমা করে সালমা। বেশ কিছু জমে গেলে সে গুলো বিকরি করে তারার খাতা পেনসিলের খরচ চালায়। মকবুল আর মকবুলের মায়ের অবজ্ঞা সালমাকে দিয়েছে প্রচন্ড গাত্রদাহ।  সে কিছুতেই হার মানবে না। তা কাগজ আর মাগাজিন পেয়ে আরও একটা উপকার হয়েছে তাদের। অবসর সময় বসে মা-বেটিতে ওগুলো পড়ে আর ছবি দেখে। কখনও বা মুদির দোকানি জলিলের জন্য বানায় কিছু ঠোংগা। তাতেও দুটো পয়সা হয় বৈকি।

তারার মোটে দু প্রস্থ কাপড়। এই দুই প্রস্থ কাপড় সে পরিষ্কার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরে। সেদিন সব জামা কাপড় ধুয়ে শুকোতে দিয়ে সে একটা ছেঁড়া ত্যানা পরে ঘরের কোণে লুকিয়ে বসেছিলো। আকাশে মেঘ জমেছে মা ফেরেনি যে কাপড়গুলো এনে দেয়। খবরের কাগজ আর বই পড়ায় বুদ্ধি তার এখন যেন ঝকঝকে তলোয়ার! সে অনেকগুলো খবরের কাগজ লম্বাটে করে ভাঁজ দিয়ে একটা দড়িতে সার সার করে সাজিয়ে কোমরের সাথে বেঁধে নিলো স্কার্টের মত। তারপর আর একটা কাগজে মাথা গলানোর মত করে কেটে, পরে নিয়ে কোমরের কাছে বেঁধে নিলো মাথার লাল ফিতে দিয়ে। জামবুরার খোসাটা মাথায় দিয়ে সে বেশ পরিশীলিত ভাষায় চীৎকার করে বললো, 'এই হনুফা দেখ কি পরেছি। তার বুদ্ধিদিয়ে সে তার দৈন্যতা আর সবার উপহাসকে বুড়ো আংগুল দেখাল। আর ঠিক তখনই রুকসানার চোখে পড়ে গেল তারা। রুকসানা এসেছিলো বস্তিতে কিছু সামাজিক কার্যক্রম নিয়ে। তিনি একটি নামকরা বিজ্ঞাপন সংস্থার মালিক। তিনি তারার  ছবি নিলেন আর ছাপলেন 'অনিন্দিতায়'। খুব কাটতি হলো সাময়িকিটির। রুকসানা ঠকালেন না তারাকে। নিয়মিত তাকে কাজ দিলেন এবং পড়াশোনার খরচ দিয়ে তাকে গড়ে তুললেন। তারা আগিয়ে যাচ্ছে, সালমা আজ সফল। ওরা আজ সোচ্চার 'পৃথিবীতে মকবুল ছাড়াও বেঁচে থাকা যায়'। জয় তারা, জয় সালমা। জয়তূ মেধা, আর  জয়তু অধ্যবসায়। বিজিতার কনক মুকুট আজ ওদের শিরে।

No comments:

Post a Comment