Saturday 19 November 2016

অদ্ভূতুড়ে

সে ছিল ঘন ঘোর বর্ষার সময়।সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে ঝর-ঝর,ঝর ঝর।'কাঁপে পাতা পত্তর'।কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য যদি বা কমল তাও তা পড়তে থাকল টিপ টিপ,টিপ টিপ।আকাশ তার  সুরমা- কালো মেঘের পর্দাখানি নিয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি নেমে এসেছে,একেবারে কাছে।এত বৃষ্টি কদিন ধরে একটানা,সাথে দমকা বাতাস আর বিজলির খেলা চলছে যে প্রাত্যহিক কাজকর্ম গোল্লায় যেতে বসেছে।আমাদের এবং আর সবার স্কুল থেকে ছুটি ঘোষণা করেছে।স্কুল বন্ধ কি মজা!পড়া নেই কি মজা!কিন্তু সে আর কদিন।প্রথম কদিন ঘরের ভেতরে খেলাধূলো বেশ লাগল।স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা রহস্য বইগুলো পড়লাম কাঁথামুড়ি দিয়ে।ঘন দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া,সূর্য বিহীন মৃদু আলো,ক্ষণে ক্ষণে কড় কড়াৎ বাজের আওয়াজ এমন দিনেই তো রহস্য গল্প জমে ভাল।এক সময় বই গুলোও শেষ হলো,খেলনাগুলো নিয়ে খেলাও শেষ হলো ,কিন্তু বৃষ্টির ঝম ঝমিয়ে পানি পড়ার যেন কোন শেষ নেই।আমাদের বাড়ীটি কাঠের তৈরী,লোকে বলে জাহাজ-বাড়ী।উঁচু উঁচু ,মোটা মোটা কাঠের পায়ার উপর ঘরখানি বসানো।পায়ার আশে পাশে তলাটা ফাঁকা।কুকুর,বিড়ালের দিনের বেলা, অনেক সময় রাতের বেলাতেও নিরুপদ্রপ ঘুমানোর জায়গা।

তিনখানি কাঠের  সিঁড়ি বেয়ে,দরজা পেরিয়ে তবে নীচ তলায় ঢোকা যায়।নীচ তলার মেঝেয় কাঠের পাটাতন দেওয়া।নীচ তলায় মা রাঁধা-বাড়া করেন।আমাদের খাওয়া দাওয়া,পড়াশোনা সবই নীচ তলায়।পাটি পেতে, কখনও বা মোছা মেঝে খানির উপর বালিশ নিয়ে দিনের বেলা আমরা ঘুমুই। ছোট শহর, বাড়ী ঘর এমনিতেই অনেক ফাঁকা ফাঁকা।দোতলা তিনতলা বাড়ীঘর কিছু দেখা যায় বটে তবে বেশীর ভাগই টিনের একচালা দোচালা আর আছে আরও কিছু বেড়ার দেয়ালের ছোটছোট বাড়ীঘর।সারা শহর খুঁজলে এমন জাহাজ বাড়ী  একটি কি দুটি দেখতে পাওয়া যায়।আমার পিতা কি ভাবে যে এমন অদ্ভূত  সুন্দর একটি বাড়ীর সন্ধান পেলেন!খুব গর্বের ব্যাপার আমার জন্যে,বন্ধু- বান্ধবরা মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভূত বাড়ীটি দেখতে আসে।তাদের সবার চোখে একটা ঈর্ষা খেলা করে বেশ বুঝতে পারি।তখন মনে মনে বাবার এই বিশেষ বাড়ীটি পছন্দ করাকে তারিফ করি।আমার বেশ অহংকার হয়,নিজেকে কেউ কেটা একজন ভাবতে ভাল লাগে।

আমার ছোট আর একটি ভাই ও বোন আছে।ভাইটি তো যেন পথ ভোলা এক দেবদূত,ভুল করে আমাদের ছোট্ট কাঠের বাড়ীটায় আশ্রয় নিয়েছে।কি মায়াময় মধুমাখা তার কথাবার্তা,আর কি চমৎকার মন কাড়া নিষ্পাপ হাসি।
নীলাভ সাদায় তিমির কালো পুতলীর, জল টলটলে সদা-অবাক দুটি চোখ।আমাকে ডাকে 'দাম্মা' বলে।ওর 'দাম্মা' ডাকে আমি হই দিশেহারা।কিন্তু আজ কি হল?আমি অবাক হচ্ছি ওর আচরণে।খানিক আগে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল,দাম্মা,আমার ফাই ইন্জি,আমার ফাই ইন্জি।এনে দাও,এনে দাও।ওর জন্যে আমি প্রাণ পাত করতে পারি এমনই ভালবাসি আমি ওকে।বোনটাকেও কি আমি কম ভালবাসি!আমি যেন ভালবাসতে আর ভালবাসা পেতেই জন্মেছি।ভালবাসায় ভরপুর এক স্বর্গ আমাদের এই জাহাজ বাড়ী।কত সকালে ঘুম ভেংগে দোতলার মেঝের লম্বা ফাটা দিয়ে বাবা-মাকে পরস্পরের হাতে হাত নিয়ে চা খেতে দেখেছি।অথবা দেখেছি নির্ণিমেষে পরস্পরের দিকে অপলক চেয়ে থাকতে।আমার ছোট ছ'মাস বয়সের বোনটি আমায় দেখলেই অবোধ্য ভাষায় 'তাতা','তাতি' নানান শব্দ করে দুহাত তোলে কোলে ওঠার জন্যে।কোলে উঠে ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে দিয়ে আরামে আহলাদে বিগলিত কুঁ কুঁ আওয়াজ করে।কিন্তু আজ কি হলো।পৃথিবী হঠাৎ এত এমন বদলে গেল কেন?

ফাই ইন্জি অর্থাৎ ফায়ার ইনজিন নামে খেলনাটির রহস্য উদঘাটনে ব্যাপৃত হলাম।জিঞ্গাসা করলাম,কি হয়েছে তোমার ফায়ার ইন্জিনের?পড়ে গেছে নদীতে।নদীতে?অর্থাৎ পানিতে; অঝোর ধারার বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে।দমকা বাতাস থেমেছে।কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে সবিরাম।আমাদের জাহাজ বাড়ীর নীচের তলাটা দেড় মানুষ সমান উঁচু পানিতে ডুবে গেছে।একতলার ভিতর দিয়ে দোতলায় ওঠার যে সিঁড়িটা সেটা প্রায় তলিয়ে গেছে।বাবা সেদিন অফিস গেলেন নৌকায় করে।দুদিন তিনি আসেন না তাঁর খবরের কাগজের অফিস থেকে; তিনি আসবেন না দু রাত, খুব নাকি কাজ পড়েছে।আশ্বাস দিয়ে গেছেন আগামী কাল বিকেলের মধ্যেই নাকি বৃষ্টি থেমে যাবে আর পানি নাকি দ্রুত নেমে যাবে।বাবা এসব কি বলেন,আমি দেখছি আকাশ মাটির তৈরী পোড়া হাঁড়ির তলার মত ঝুলে আছে পৃথিবীর উপর!কি জানি হবেও বা।বাবা যে পত্রিকা অফিসে কাজ করেন,তারা যে আগাম সব কিছু জানতে পারে।মায়ের ভারী ভরষা বাবার উপর।

আমি ঝাঁপিয়ে পানিতে পড়লাম।কিন্তু খেলনা কই?পানি যে আমার মাথার উপর দিয়ে বইছে।ভাগ্যিস সাঁতার জানি।আনাচে কানাচে কোথাযও নেই।প্রথমে মনে হয়েছিলো বড় জাম্বুরা গাছের গুঁড়ির সাথে আটকে ওটা হয়ত বা ভাসছে।না তা তো নয়।ভাইটার হাসিমুখ দেখতে চেয়েছিলাম,বীরত্ব দেখাতে চেয়েছিলাম।কিন্তু না এবার উঠে পড়তে হবে।এটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।পানির একটা জোরালো টান অনুভব করছি খালের দিকে।এবার উঠব।সাঁতরে দোতলার বারান্দার কাছাকাছি গিয়ে উপরে রেলিং ধরে এক হ্যাঁচকা টানে উপরে উঠতে চাইলাম।বাদ সাধল ছোট ভাই।কতৃত্বের সুরে সে বলল খুঁজে নিয়ে এস ফাই ইন্জি,এখনই উঠছ কেন?চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম।এভাবে তো কখনও কথা বলে না।লক্ষ্য করলাম ওর চোখ দুটো জ্বলছে অংগারের মত।চেহারা হয়ে উঠেছে ভয়ংকর,যদিও ওর আগেকার চেহারার আদলটুকু আছে।আমি আবারও উঠতে চেষ্টা করলাম।এবার আমার ভাই কোথা থেকে একটা লোহার রড এনে আমার আঁকড়ে ধরা হাতের আংগুলে আঘাত করল ।প্রচন্ড যন্ত্রণায় হাত ছেড়ে দিয়ে
আমি একটু তফাতে সরে আসি।এমন সময় মা এলেন ঝুল বারান্দায়।আমি তাঁকে সমস্যাটা জানালাম।মা একটা ক্রুর নিষ্ঠুর হাসি হেসে বললেন,খেলনাটা নিয়ে তবেই উঠবি।মা আমি যে আর সাঁতরাতে পারছিনা।মা বলেন খেলনা নিয়ে তবেই উঠবি,আগে নয়।মা ঘরের ভিতর চলে গেলেন।ভাবলাম এতদিন কোন ভালবাসার ছলনায় তাহলে ভুলেছিলাম।আমি যাদের এত ভালবাসি এরা তাহলে কারা?এরা কি তবে দূরাত্না,প্রেতাত্না।আর একবার রেলিংটা ধরে উঠতে চেষ্টা করলাম।নিমেষের ভিতর কোথা থেকে আমার অত প্রিয় ভাই একটা জ্বলন্ত চ্যালা কাঠ নিয়ে এসে আমার আংগুলে চেপে ধরল।উঃ, মাগো বলে চীৎকার করে উঠে ডুবে যেতে থাকলাম।আমি শ্বাস নিতে পারছি না।একটু বাতাস আহ্ মাগো একটু বাতাস।খুব জোরে টেনে শ্বাস নিতে চাইলাম।দম বন্ধ হে আসছে। এখুনি আমি মারা যাব।

এই তো শ্বাস নিতে পারছি।আমার চোখের দৃষ্টি আমার ঘরের ছাদে। বিছানায  ২০১৬ র নভেম্বর  মাসের ১৫ তারিখে আমি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম।স্বপ্ন দেখছিলাম পঞ্চাশ দশকের পটভূমিকায়।আমাদের কোন জাহাজ বাড়ীও ছিল না আর আমি দুই ভাইএর  পর সর্বকণিষ্ঠ বোন ।স্বপ্ন কত অদ্ভূতুড়ে হয়।আপনারা কি বলেন?

Friday 4 November 2016

শশধর ও কয়েক জন মৌওয়াল

বিছমিল্লাহতেই গলদ। গল্পের নামকরণ কি বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারি?  মৌওয়াল বাহিণী কিন্তু শশধরের নেতৃত্বে পরিচালিত নয়।আর শশধরের সেই অভিজ্ঞতাও নেই মধু সংগ্রহে নেতৃত্ব দেওয়ার মত।তবু শশধরের এই গল্পে মূল চরিত্র হয়ে উঠা কেন অনিবার্য হয়ে উঠল তার  পেছনে  অনেকগুলো শক্তিশালি কারণ আছে বইকি।

এরকম শশধর সমাজে অনেক আছে।এমনই সংগ্রামী,চৌকস,কর্তব্য-পরায়ণ,আর তেমনই ভাবালুতায় আচ্ছন্ন প্রেমিক ও স্বামী।তবু,তবুও লেখকের দূরবীনে শশধরই উজ্জ্বলতায় ভাস্বর।সম সাময়িক বাস্তবমুখি সিদ্ধান্ত গ্রহনে শশধর বড় যুগোপোযোগী এবং মনস্কতায়  অনেকটাই আধুনিক।এটা হয়তো বা দৈবাৎ ঘটনীয় একটা ঘটনা।দূরবীনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু অন্য যে কেউ হতে পারত।

যাই হোক আবার পিছু নেই গল্পের,দেখি গল্প  আমাদের কোথায় নিয়ে যায়।
বেশ কতকগুলো মাস কেটে গেছে শশধরের মাছ শিকারের সময় কুমির কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর।দীর্ঘ সময় হাসপাতালে কাটলেও চিকিৎসক তার বাম চোখটি রক্ষা করতে পারেননি। শশধর বলছিলো চোখটা গেছে,কতগুনা টাকাও গেলো,আমার এখন এই অবস্থা।ঋণে জর্জরিত শশধর আজ  দিশেহারা।

শশধর রওয়ানা হয়েছে মৌওয়ালদের সাথে।কমপক্ষে দু-তিন সপ্তাহের ধাক্কা ভাগ্য সহায় না হলে।তাদের ছয়জনের দল। সংগে আছি আমরা দু'জন। এ সময় মধু সংগ্রহের কাজে বেশ ভালো লাভ হবে-তাদের আশা।শশধর আশা করে বাড়তি টাকাটায় দেনা শোধ করতে পারবে।কপাল ভালো হলে হয়ত নৌকাটাও মেরামত করে নিতে পারবে। সবই ভগবানের ইচ্ছা।এমনটাই ভাবে দলপতি আকবর আলি এবং দলের আরও পাঁচজন।যাত্রার প্রাক্কালে আকবর নদী ঘাটে দু-রাকাত নফল নামাজের মোনাজাতে বলেছিলো' ইয়া গাফুরুর রাহিম তোমার এই গুনাহগার বান্দার সহায় হও।তার জান মালের হেফাজত কোরো।

কম বড় বহর ছিলো না আমাদের।আমি তখন একটা বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছিলাম সুন্দরবনের বিভিন্ন জীব ও প্রকৃতি নিয়ে। আমার সহযোগী  রমেশ গোমেজ আর রাকিব হায়দর আর আমি আবার ওদিকে শশধরের ছ'জন,মাঝি আরও দুজন  সাকুল্যে এগারজনকে নিয়ে যেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সে কথায়  নাহয় আবার পরে ফিরে আসা যাবে।

শশধরের সাথে আমার প্রথম দেখা চিত্রা নদীর কিনারে এক লোকালয়ে শশধরের গ্রামে।তখন কাজ করছিলাম 'বাংলাদেশে ভোঁদড় ও তার পরিসংখ্যান' এর  উপর ।জীববিজ্ঞানের  উপর পড়াশোনা করেও কোন স্থায়ী  চাকুরী জুটাতে পারিনি এমনই অপদার্থ আমি।নানা ঘাটের জল খেয়ে বেড়াচ্ছি আর খোদার খাসীর মত গতর হচ্ছে।

 আমরা দুটি নৌকায় রওয়ানা হলাম মধু সংগ্রহে। চৈত্র মাস তখন তার যৌবন হারিয়েছে।বৈশাখ যেন তখন অনুঢা কিশোরি। এখনই মধু সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।ফাল্গুনে যখন অরণ্যে ডালে ডালে পুষ্পোৎসব হচ্ছিল মৌ পিয়াসী মৌমাছি  তখন ফুল উজাড় করে মধু  আহরন করে গৃহস্থের মত গোলা ভরেছে।কম পরিশ্রম,সময় আর ধৈর্যের ব্যাপার নয় প্রায় আশিটার মত ফুল থেকে উড়ে উড়ে ফুলের মধু সংগ্রহ করা!অনুসন্ধিৎসু জনি  জিঞ্গাসা করে আচ্ছা স্যর ছোট বেলায় তো ফুলের মধু কতই খাইছি,সেই মধু আর মৌচাকের মধুর স্বাদ তো এক না।এমন ক্যান? প্রশ্নটা বুঝতে পারলাম। জানালাম মৌমাছি তার লম্বা নলাকৃতি  জিহ্বার সাহায্যে ফুলের মধু প্রবেশ করায় তার বিশেষ ভাবে প্রস্তুত পাকস্থলিতে।সেখানে ফুলের  জলীয় মধু পাকস্থলির বিভিন্ন পাচক রসের সাথে মিশ্রিত হয়ে ঘন মধু তৈরী হয়।আর তখন মৌমাছি মৌচাকের ছোট ছোট ঘরে  সেগুলো উগলে দিয়ে মোম দিয়ে তালা মেরে দেয়। সবার চিন্তা এখন মৌমাছির সেই গোলা ঘরের সন্ধান পেলেই হয়। যখন  তীরে পৌঁছলাম,তখন ভাটার টান শুরু হয়েছে নদীর জলে। স্হির রূপোলি রাংতার মত জল কেটে নৌকা থামল নদীর কিনারায়,থকথকে কাদায় ;সূতো কাটা ঘুড়ির মত গোত্তা খেয়ে ।সাত সকালেই মার্তণ্ড মহাশয় তাঁর অগ্নিকুন্ড জ্বেলে বসে আছেন।সেদ্ধ হতে চলেছে চরাচর। তাতে মহাশয়ের কোন দৃকপাত নেই। আমরাও থোড়াই কেয়ার করে একে একে নামতে লাগলাম প্যাচপ্যাচে পচা কাদায়।যেখানে  সেখানে ঘন হয়ে উদ্ভিদের  শ্বাসমূলগুলো আকাশমুখি হয়ে রয়েছে যেন সৈনিকের বেয়নেট।কাদাখোঁচা পাখির মত লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে সবাই,সর্ব পেছনে আমি আর আমার সহকর্মীরা হাঁটু পর্যন্ত উঁচু গামবুট পায়ে। স্লথ গতিতে যখন স্যাঁত স্যাঁতে ডাঙায় এলাম ততক্ষনে শশধর,আকবর আর তাদের সংগীরা বন-বিবির পূজা শুরু করেছে।

আকবর আলি মৌওয়াল দলনেতা- খাটো,কৃষ্ণকায়,বলিষ্ঠ পুরুষ, তোবড়ানো ডান গাল বরাবর গভীর ক্ষত। বাঘের জোরালো থাবায় ডান চোয়ালের তিনটে দাঁত অস্তিত্ব হারিয়েছে।শুনেছি অনেক জায়গায় দল-নেতা সাজুনি নামে পরিচিত ।মধু সংগ্রহের সময় মউয়ালরা পরস্পরের সাথে কলহ বিবাদ করে না।মিথ্যা কথা সে সময়ের জন্য সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য । মধু সংগ্রহে আকবরের বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতা আর আর্থিক স্বচ্ছলতা তাকে নেতৃত্বে আনুকূল্য  দিয়েছে। তার চক মিলানো বড় টিনের ঘর।ঘরের দরজার কাছে সিঁড়ি বরাবর দুপাশে সন্ধ্যা মালতির ঝোপ , শান্তি আর স্বচ্ছলতার নীড়।তার নিজস্ব নৌকাখানি নিয়ে সে বেরোয় মধু সংগ্রহে। বন বিভাগের মধু সংগ্রহের আর নৌকা নিয়ে বনাঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি পত্র দুটিও  যে তার নামে।শশধর তার  অতি শৈশবের পাঠশালার বিশিষ্ট বন্ধু।শশধরের একান্ত আগ্রহই শশধরকে আকবরের মৌওয়াল বাহিণীতে যুক্ত করেছে।সে মৌওয়াল দলে একেবারে আনকোরা। এই শশধর আর তার বন্ধু আকবরের সহযোগিতাতেই আমি এই মউয়াল দলের সাথে সুন্দরবনে আসতে পেরেছি।সেই যে বলছিলাম ভোঁদড় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি প্রথম শশধরকে দেখি। পরিমিতভাষী,ছ'ফুটি লম্বা,একহারা গড়নের শশধর যেমন মাথায় অনেককেই ছাড়িয়ে যায়,তেমনি তার চরিত্রের আরও অনেক গুনাবলী ওকে আমার  কাছে অনেকের চেয়ে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।ঠিক আমার সামনে সামনে ও হাঁটছিলো,একটু যেন আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার অভিলাষে।ও আমাকে জানিয়েছিলো এই চৈত্র বৈশাখ মাসই মধু সংগ্রহের উপযুক্ত সময় আর এসময় সব মৌওয়ালরা তাদের কাজে ব্যস্ত হে পড়ে।বন-বিবির পূজোর সময় শশধর আমাকে জানাল,হিন্দু বলেন আর মুসলমান বলেন বন-বিবিরে আগে পূজা না দিয়ে জংগলে ঢুকা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।

এসব কি করছ আকবর,তুমি মুসলমান হয়ে পূজা করছ তাও আবার এক নারী মূর্ত্তিকে,আমি বললাম। তড়িৎ জিহ্বা কামড়ে আকবর বলে, ছি ছি একথা শুনলেও পাপ হয় স্যার।সংগে সংগে সে  পরম ভক্তি ভরে পুনরায় বনবিবির উদ্দ্যেশে দু'বার কপালে হাত ছোঁয়াল।বেশ উচ্চস্বরে বলে উঠল,অপরাধ নিও না গো মা।ওরা পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে নিম্নস্বরে কিছু বলাবলি করল আমার অগোচরে। ফটোগ্রাফার রাকিব ফিসফিস করল,স্যার ওরা বোধহয় কোন অশুভ কিছুর আশন্কা করছে।বনবিবিকে তারা 'মা' বলে সম্বোন্ধন করে।সেই মাকে নিয়ে নাকি আমার বিরূপ সমালোচনা!প্রাচীন কাল থেকে,জানা যায়  সুন্দরবনে মনুষ্য পদার্পনের জন্মলগ্ন  হতে  এলাকার অধিবাসীরা  বনবিবিকে নিজেদের রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে মান্য করে।একটি প্রাচীন গল্প মউয়ালদের মুখে মুখে ফিরছে যুগ যুগান্তর হতে। জলিল তার গল্পের ঝাঁপি খুলল ।অভিনব তার গল্প বলার কৌশল,  বিমুগ্দ্ধ  শ্রোতা তার গল্পে চমৎকৃত না হয়ে যাবে না। জলিল বলল সে অনেক অনেক কাল আগের কথা মউয়াল ধনা আর তার ভ্রাতুষ্পুত্র দুখি মধু সংগ্রহে এই গহীন বনে প্রবেশ করেছিলো।সুন্দরী,গর্জন,গরান,কেওড়া,গোলপাতা  আরও বিবিধ নাম জানা, অজানা বৃক্ষ,গুল্ম,লতা,পরগাছায় সুন্দরবন তখন ছিল আরও গহীন।অনেক ঘোরাঘুরি করার পরও যখন তারা মধু না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় দখিনা রায় বা ব্যাঘ্র মশাইর আবির্ভাব ঘটল। ক্রুর দখিনা রায় এক নিষ্ঠুর প্রস্তাব উপস্থাপন করল-জানালো ধনাকে অকল্পনীয় পরিমাণে মধু পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সে করে দেবে কিন্তু পরিবর্তে তার দুখিকে বিসর্জন দিতে হবে।লোভ এমনভাবেই ধনাকে গ্রাস করল যে প্রাণের টুকরো ভ্রাতুষ্পুত্রকে বিসর্জন দিতে সে দ্বিধা করল না।মধু আর মোমে উপচে পড়া নৌকা নিয়ে কিশোর সংগীকে ফেলে সে পলায়নপর হলো।আক্রান্ত দুখি উপায়ন্তর না পেয়ে চীৎকার করে গর্ভধারিণী মাকে ডাকতে লাগল।সেই ডাক শুনে মাতারূপী বন-বিবি তার নিজ ভ্রাতা  শাহ্ জংগলীগে মুগুর হাতে পাঠিয়ে তাকে রক্ষা করলেন।চমৎকৃত হলাম উপকথার চমৎকারিত্বে আর গল্প বলিয়ের কাহিনীর জাল বোনার পটুতায়।আমরা ততক্ষনে বনের বেশ গভীরে প্রবেশ করেছি।সবাই সার বেঁধে হাঁটছি।গা ছমছম করছে।

নাগরিক কোলাহল মুক্ত উষ্ণ আর্দ্র পরিবেশ। শহুরে কোলাহল নেই বটে কিন্তু বনের  বিভিন্ন প্রজাতির পাখির  কল-কাকলি,বানর  প্রজাতির হুপহাপ আওয়াজ,নানা ধরনের রহস্যময় খসখসে শব্দে ভীতির শিহরণ অনুভব করছি শিরদাঁড়া বরাবর।এ বন্য কোলাহল যে কাউকে নিয়ে যেতে সক্ষম অন্য এক ভাব জগতে।ঘামছি আমি,আমরা সবাই। দর দর করে ঘাম পড়ছে সবার শরীর বেয়ে।ভাবতে অবাক লাগে আমি কিনা পৃথিবীর অন্যতম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল সুন্দরবনের অপরূপ,ভীতিকর পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছি। বিশালত্ব যেখানে সৃষ্টির অপার রহস্যে চমকিত করছে অনুক্ষন।বৃহদাকার গাছের গুঁড়িতে অসংখ্য ঝিঁঝিঁ পোকা।বৈজ্ঞানিকি সাময়িকিতে পড়েছিলাম প্রকৃতির  তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে এই পতংগটির প্রতি মিনিটে ডাকের সংখ্যার নাকি একটি প্রত্যক্ষ আনুপাতিক সম্পর্ক আছে।হয়ত বা।কি অদ্ভূত রহস্যময় পৃথিবী! তার কতটুকুই বা জানি।ভাবছি দশ হাজার বর্গকিলোমিটার এই সুবিশাল বনভূমির যা অর্ধেকের বেশী আমার দেশ মাতার অধীন তার কতটুকুই  বা আমরা চিনি,আর কতটুকু পরিচর্যা,রক্ষাই বা করতে পারব।

মউয়ালদের সবার হাতে বড় রামদা' আত্নরক্ষার্থে যা অপরিহার্য।মাঝে মাঝেই এক একজন তারস্বরে চীৎকার করে উঠছে হিংস্র পশুর মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে।আমিনুরের হাতে ক্যানেস্তারাটা কখনও কখনও বেজে উঠছে ঢ্যাঢ্যাং ঢ্যাঢ্যাং  করে।বাঘ ভয় না পেয়ে পারে!বাঘের সংখ্যা অনেক কমে গেছে জানা গেল।আমিনুর রোগা,চশমা চোখে ,মাথায় আধ ময়লা সাদা কিস্তি টুপি,ছাগল দাড়ি নাড়িয়ে সব সময় বিজ্ঞের মত কথা বলে,সে সব কথায় সত্যতা থাক বা নাই থাক। ও হাঁটছে ঠিক শশধরেরর আগে আগে।।থেকে থেকেই  বলিষ্ঠ,নোংরা কামুক চেহারার হালিম বানর হোক,পাখি হোক বা কোন অদৃশ্য বস্তুকে গাল দিয়ে উঠছে অশ্রাব্য ভাষায় ।ওর হাতে মহিষের শিং এর তৈরী এক বিরাট ভেরী,ফুঁ দিলে বিকট ভাবে বেজে ওঠে।।সবার পিছন পিছন আসছে জয়নুল ইসলাম ওরফে জনি সম্পর্কে আকবর আলির ভ্রাতুষ্পুত্র । টিয়া সবুজ রংএর পরিচ্ছন্ন গেন্জী,বুকে কারিনা কাপুরের মুখের ছবি আঁকা।স্মিত হাস্য মুখে মাঝে মাঝে হিন্দি বা বাংলা চলতি গানের দু'এক কলি গেয়ে উঠছে।অস্থির চিত্ত তাকে অস্থির করে রেখেছে- হাঁটার সাথে সাথে তার হাতের দা' গাছ,লতা,গুল্ম নিদেন পক্ষে বাতাসকে কাটছে।

একটা ভ্যাঁপসা,সোঁদা গন্ধ অরণ্যে যে আরণ্যকীয় অনুভূতি এনে দিয়েছে তা অবর্ণনীয়! সভয়ে বার বার ইতি উতি চাইছি। দূরে এক ঝলক এক চিত্রা হরিণের অপসৃয়মান দেহ দেখতে পেলাম।'আইছে' বলে আমিনুর  চাপা গলায় সবাইকে সতর্ক করল। তার অর্থ বাঘ  আসে পাশে কোথাও আমাদের নিকটবর্তী হয়েছে।আমিনুরের ক্যানেস্তারা বেজে উঠল সরবে।সবাই সতর্ক।বুঝলাম বাঘ পিছু নিয়েছে। হালিমের হাতের মহিষের শিংএ তৈরী ভেরীও বেজে উঠল একবার।ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারব তো! শশধর ঘনিষ্ঠ হয়ে এল আমাদিকে সাহস যোগাতে।এদের চীৎকার চেঁচামেচি আর ক্যানেস্তারার বিকট শব্দের সাথে বাঘের গায়ের তীব্র বোঁটকা গন্ধ ক্রমশ হাল্কা হয়ে এল ।আমাদের সবার মাথার পেছনে বড় বড় চোখ দেওয়া মুখোস, বাঘকে ধোঁকা দেওয়ার কায়দা।ওরা বলল আপাতত বাঘ দূরে সরেছে তবে এটা সাময়িক ব্যাপার ,সতর্ক থাকতে হবে।

নাম না জানা ফুলের মন মাতোয়ারা মিষ্টি হাল্কা একটা সুবাস যেন আচ্ছন্ন করে  ফেলছিলো।জিঞ্গাসায় জানলাম  গরান,পসর,ধুন্দল,কেওড়া আর খালসীর গত যৌবনা ফুলের মিশ্রিত সুগন্ধি এটি।বসন্তে পুষ্পভারে  সমৃদ্ধ বৃক্ষ শাখাগুলোয় মৌ-পিয়াসী মৌমাছির আনাগোনা শুরু হয়।ওরা বাসা বানানো শুরু করে ডালে ডালে।এক একটা চাকে একজন স্ত্রী মৌমাছি,আর পুরুষসহ অসংখ্য শ্রমিক মৌমাছি থাকে।স্ত্রী মৌমাছি প্রকৃত অর্থে একজন রাণী। সর্বোতোকৃষ্ট খাদ্য  ভক্ষন আর ডিম প্রসব ছাড়া তার কোন কাজ নেই।শশধর বলল পসর আর গরানের ঈষৎ লালচে মধু আর নাকি কম সুবাসী আর তাড়াতাড়ি দানা ধরে যায়।ওদিকে আবার খালসী আর কেওড়ার সাদা ফুলের মধু হাল্কা সোনালি আর সুগন্ধিতে ভরপুর।কত কিছুই না জানতে পারছি।মন ফিরে এল মৌমাছির জীবন ব্যবস্থায়।প্রকৃত রাণী(রাজ)তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। শ্রমিক মৌমাছি সেখানে ক্রীতদাস।কিন্তু কি সুশৃন্খলিত ভাবে সব নিয়ন্ত্রিত।শশধর ব্যক্ত করল সেরকম অনুকূল অবস্থায় নাকি এক একটা চাক থেকে বিশ কিলো পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়।আমিনুর ছাগল দাড়ি নাড়িয়ে সরব হলো,আমি একবার আশি কিলো মধু পাইছিলাম।বলার সময় তার গলার স্বর হঠাৎ যেন একটু খাদে নেমে গেল।তবুও তা আকবরের কানে গেলে আকবর ব্যঞ্গ করে বলে ওঠে,কোন্ বছর রে আইনু? মিছা একটু কম ক।তুই তো সব সময় আমার সাথেই! আমিনুরের প্রতুল মধু প্রাপ্তির কথায় মনে পড়ল এপিস ডরসাটা প্রজাতির মৌমাছির বিশাল চাক থেকে এ পরিমান মধু পাওয়া যায়।সবাই বেশ নীচু স্বরেই কথা বলছিলো,এটাই এখানকার নিয়ম।

হঠাৎ শশধর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে,হাত প্রসারিত করে এবং আমার চলার গতি রোধ করে।তার দৃষ্টি অনুসরণে  হিলহিল করে একটা চকচকে কালো সাপকে পাশের ফার্ণ-ঝোপ থেকে বেরিয়ে চলে যেতে দেখি অদূরে বাসক ঝোপের আড়ালে, উপরে যার ঝুলন্ত মাধবী লতার প্রস্ফুটিত সতেজ বল্লরি।।হালিম তার স্বভাব মতো সাপটার সাথে নিজের অনৈতিক  যৌন সম্পর্ক জড়িয়ে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করে ওঠে।স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা মাটিতে রকমারি কীটপতজ্ঞ;ঝোপ- ঝাড়ে অসংখ্য নানা আকারেের নানা রংএর মাকড়সা নিরলস ভাবে জাল বুনে চলেছে।ঘন অরণ্যের বাহারি পত্রদল এমনই গায়ে গায়ে সন্নিবেশিত যে ঊর্ধে  নীলাম্বরের উদার দৃশ্যপট ছিন্ন ভিন্ন।পাতার ফাঁকে ফাঁকে আসা হলদে রোদ মাটিতে  কিছু আলো ছায়ার  দূর্বল আলপনা এঁকেছে ।দলের সবার দৃষ্টি গাছের উুঁচু ডালে মৌচাকের সন্ধানে।ইতিমধ্যে সবাই বনের বেশ গভীরে চলে এসেছি।বাঘ বাবাজির উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে।খুব
অস্বাভাবিক ভাবে অরন্যে একেবারে প্রবেশের সাথে সাথে মামা আমাদের পিছু নিয়েছে।মউয়ালরা একটু শশব্যস্ত।সবার মন কূ গাইছে। এমন তো কখনই ঘটেনি।আকবর তো সবাইকে জিঞ্জাসা করেই বসল,এই তোমরা সবাই বউ,ঝিদের মাথায় তেল-সাবান না দিতে কয়া আসছ তো?শশ তোমার পিসী তো আবার মরিচ না পুড়্যা ভাত খায় না,দলনেতা বলে।না !না !পিসী আগেই মরিচ পুড়্যা বোতলে ভরে রাখছে,শশধর জানায়।ওদের বউ ঝিরা এ কটা দিন ভেজা কাপড়ও নিংড়াবে না । পরিবারের পুরুষদের নিরাপত্তা ও মংগল কামনায় এ আচার অনুষ্ঠান গুলো মউয়াল পরিবারের মেয়েরা খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করে।একটু মানসিক দ্বন্দে পড়লাম,মউয়ালরা ভাবছে কিনা বন-বিবিকে নিয়ে আমার উক্তি বনবিবিকে কুপিত করেছে। ওরা বারবার উচ্চারণ করছে!কখনও তো যাত্রার শুরু থেকেই ওরা বাঘের উপস্থিতি অনুভব করে না।

জয়নুল ওরফে জনি চাপাস্বরে বলে ওঠে,কাকা ঐ উই যে  উইই।সবাই চাপা স্বরে জানতে চায় কই? কই?।ঐ যে হাতের ডান দিকে উরপে তাকান।জনি উপরকে 'উরপে' বলেই উচ্চারণ করে গোড়া থেকেই লক্ষ্য করছি।সবাই সসব্যস্ত হয়ে উঠল। নজরে পড়ল বেশ বড় -সড় একটা মৌচাক।দলের ভেতর একটা আলোড়ন উঠল।জনি ঘ্যাস ঘ্যাস করে কিছু শুকনো আর সতেজ  ঝোপ-ঝাড়ের শাখা প্রশাখা কেটে ফেলল।শুকনো ডালপালা গুলোকে সবুজ ডালপালাহাঁটছে দিয়ে বেশ করে মুড়িয়ে লতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধল।ততক্ষনে হালিম হাতে ধারাল দা নিয়ে গাছে ওঠার জন্য প্রস্তুত।সবাই জামার হাতা নামিয়ে ফেলে,শুধু চোখ বাদ দিয়ে মাথা-মুখ গামছা দিয়ে জড়িয়ে নিল।আমরাও আমাদের মুখ, মাথা ঢেকে ফেললাম।হালিমের ভেরী এখন শশধরের হাতে।আমিনুর হাতে বড় একটা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি নিয়ে চাক বরাবর  একটু নীচের একটা ডালে বসল।তর তর করে গাছে উঠে পড়ল হালিম,পকেট থেকে লাইটার বের করে শুকনো ডালপালায় আগুন ধরিয়ে দিল।নীচে বাকি মউয়ালরা সদা সতর্ক,বিশেষ করে বাঘ পিছু নিয়েছে।ধোঁয়ায় আক্রান্ত মৌমাছি ভন ভন করে উড়তে রইল।ক্ষীপ্র হাতে হালিম টুকরো টুকরো করে মৌচাক কেটে কেটে নীচে হাঁড়িতে ফেলতে লাগল।সাথে সাথে  পড়তে থাকল সোনালী রংএর মধু টুপুস টুপুস করে।প্রচুর মধু!প্রাপ্তির আনন্দে মউয়ালদের চোখ চকচক করছে।আমিও আনন্দিত এই ভেবে হয়ত অচিন্তনীয় পরিমান প্রাপ্তি বনবিবি সম্বন্ধে আমার মন্তব্যে ওদের বিরূপ ধারনার অবসান ঘটাবে।রাকিব ক্যামেরায়  মউয়ালদের সমূদয় কার্য কলাপের ছবি বন্দী করায় তৎপর রইল।রমেশ বিভিন্ন বিষয়ের উপর কিছু তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত।

বেশ নির্বিঘ্নেই মধু আর মোম সংগ্রহ হলো।এবার ফেরার পালা।আমরা আবার সেই আগের মত এক সারিতে হাঁটছি।হালিমের মাথায় মধুর হাঁড়ি,সে চলেছে সবার আগে।ঠিক তার পেছনেই  পরমানন্দিত আকবর হাঁটছে সদৃপ্ত ভংগীমায়।পেছনে ফেলে যাচ্ছি  বিশাল ক্যানভাসে আঁকা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের শ্রেষ্ঠতম শিল্পীর অপূর্ব ব্যন্জনাময় এক বর্ণিল ছবি 'সুন্দরবন'  যার পরিচয়।

প্রায় নদী কিনারে পৌঁছে গেছি।পশ্চিম আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা।বৈশাখী মেয়ে তার রুদ্ররূপে আগত প্রায়।বেতস ঝোপে এক জোড়া যুধ্যমান গিরগিটি দেখে রাকিব ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমিও একটু থমকালাম।আমার সাথে সাথে রমেশ আর শশধরও থেমে গেল।রাকিব ক্ষীপ্র হাতে সে গুলোর ছবি ক্যামেরা বন্দী করতে লাগল।ইতিমধ্যে আকবর সহ  দলের বাকি সব মউয়াল সবে মাত্র নৌকায় উঠে থিতু হয়েছে।যুগপৎ আমার আর শশধরের দৃষ্টি গেল ঝোপের আড়ালে ভয়াল  বিশলাকৃতি এক বাঘের দিকে।আমি তো স্থাণূবৎ,রমেশ আর রাকিব তন্ময় তাদের কাজে।মাটির সাথে আমার পা-জোড়া যেন কে গজাল দিয়ে গেঁথে দিয়েছে।সমস্ত শরীর আমার অবশ।শশধর এক ঝটকায় মাটিতে ঝোপের আড়ালে  আমাকে ফেলে দিয়ে ভয়ংকর এক হুন্কার দিয়ে উঠল।আমার ধাক্কায় রমেশ আর রাকিবও চীৎপটাং। ভীষণ দর্শন বাঘের সমস্ত শক্তি নিয়ে শশধরের উপর ঝাঁপিয়ে তাকে আক্রান্ত করার চেষ্টা  সাহসী শশধরের রাম-দা এর আঘাতের কারনে প্রথম দফায় ব্যর্থ হল। বীর বিক্রমে শার্দূল যখন দ্বিতীয় বার ঝাঁপিয়ে পড়ার পাঁয়তারা করছে ঠিক তখনই বাকি সব মউয়ালেরা রাম-দা নিয়ে হারে-রে-রে করে তেড়ে এল,ক্যানস্তারা আর ভেরী বেজে উঠল।লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া ব্যাঘ্র মশায়ের আর কোন উপায় থাকল না।মামার আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত হাত নিয়ে শশধর উঠে দাঁড়াল।আমরা নৌকায় ফিরলাম।দলনেতা আকবর পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার ধূলি ধূসরিত পরিচ্ছদ ঝেড়ে দিতে থাকল।সে বলল,স্যার এ যাত্রায় আমরা রক্ষা পাইলাম। বন-বিবি বাঁচায়ে দিল।উনার সম্বন্ধে কিছু বলা ঠিক না।

বেওকুফ আমি! দুঃখ প্রকাশ করলাম দল-নেতার কাছে ,দলের কাছে।বললাম আমি খুব দুঃখিত। ওরা সবাই সমস্বরে বলে উঠল, সমস্যা নাই স্যার,বন-বিবি ক্ষমা করে দিছে।নাইলে আজকে প্রাণ নিয়ে নৌকায় ফিরতে হত না।ওরা কত ভদ্র।আমার দুঃখ প্রকাশের জবাব দিল ভদ্র ভাষায়,আমাকে দিল একটু স্বস্তি। কিন্তু ওদের মন থেকে বনবিবিকে নিয়ে আমার ব্যঞ্গই যে শার্দূল আক্রমনের কারণ তাতো মুছে যায়নি।মনে হল  আমার এই আঁতলামি টুকুর তো কোন দরকার ছিল না।সহস্র সহস্র বছর হতে যে বিশ্বাস নিয়ে এ অঞ্চলের লোকেরা জীবন কাটাচ্ছে তাতে আমার অবিশ্বাসের কথাটুকু তুলে কি সুরাহা হল। বিশ্বাসই হোক বা কুসংস্কারই হোক;এতে কি বা ক্ষতি হচ্ছে জগতের। বরং এই আচার  থেকে তারা দূর্জয় সাহস, প্রচন্ড শক্তি,আর আত্নবিশ্বাস অর্জন করে যা কিনা তাদের এই বিপদ সংকুল জীবনের হয় পরম পাথেয়।আধুনিক,সভ্য সমাজে এমন তো কতই ভুবন বিখ্যাত অভিযাত্রি, শিকারি  এমনকি গবেষক আছেন বা ছিলেন যাঁদের অদ্ভুত সব বিশ্বাস,সংস্কার আছে বা ছিল।খ্যাতনামা শিকারী জিম করবেট বিশ্বাস করতেন যতক্ষন না তিনি একটি সাপ মারতে পারছেন ততক্ষন তিনি কোন শার্দূলের দেখা পাবেন না।আবার মাছ শিকারী জক্ ডুগে কখনই গভীর সমুদ্রে যাওয়ার সময় কলা বা কলা মিশ্রিত কোন খাবার জাহাজে তুলতে দিতেন না
এসব অল্প বিস্তর কুসংস্কার চর্চায় কি আসে যায়!

আমার নৌকায় 'প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স' ছিল।তুলো আর জীবাণুনাশক বের করে শশধরের ক্ষতগুলো পরিষ্কার করা হলো। ওকে আবারও ডাক্তারের স্মরণাপন্ন  হতে হবে।দুটো নৌকাই চলা শুরু করেছে।জনি ভরাট  গলায় গান ধরল....বিস্তীর্ণ দু'পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার.....ও গঞ্গা বইছ কেন।