Saturday 25 June 2016

ভোঁদড় ও একজন শশধর

শৈলবালা খুব ভোরে পূব গগনে সূর্য  উঁকি দেওয়ার আগেই গোলাপি অরুণিমা গায়ে মেখে ভোঁদড় (ধাইরা)গুলো নিয়ে পশ্চিম দিকের ঝোপালো ঢিবিগুলোতে গেছে।ভোরের আবছা আলোয় ওখানে পাওয়া যায় বেশ কিছু কাঁকড়া আর পোকামাকড়--ধাইরার খাদ্য। ভোঁদড়(ধাইরা)গুলোকে নিজেরা না খেয়ে হলেও খাওয়াতে হয়।প্রাণ ভোমরা ভোঁদড়গুলো যে ওদের জীবিকা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার।

ওর স্বামী শশধর বিশ্বাস আজ ক'দিন ধরে বাড়ীতে নেই।বাড়ী শব্দটা মনে,নাকি মাথায় এলে ওর হাসি পায়।এটাও একটা বাড়ী!!বর্ষায় চাল দিয়ে জল পড়ে।পৌষ-মাঘে উত্তুরে ঠান্ডা কনকনে হাওয়া একেবারে হাড়ে কাঁপুনি  ধরিয়ে দেয়।তবে ঘরের চালের ফুটোর কারণে কোজাগরী পূর্ণিমার আলো  ভারী মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে পর্ণ কুটিরে।মনে পড়ে  আশ্বিণে এ বাড়ীতে প্রথম রাতে শশধর ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,বউ চাঁদের আলোয় তোমারে যে কি সুন্দর লাগতেছে।ও মনে মনে না হেসে পারেনি।ওর বাবার ঘর তো দৈন্যতায় এরকম দাঁত ব্যাদান করা হাসি হাসে না।

ভোঁদড়ের সাহায্যে মাছ শিকার ওদের মত অনেক মালো সম্প্রদায়ের আদি পেশা। কয়েক শতাব্দী ধরে ওরা এ পেশার সাথে যুক্ত।শৈলবালার বাবারা জাতে কৈবর্ত। তারা যেমন মাছ ধরত জাল ফেলে আবার যুগপৎ ভাবে জাল ফেলে আর ভোঁদড়ের সহায়তায় তেমনি আবার মহাজনের জমিতেও চাষ-বাসের কাজ-কর্মে নিযুক্তি পেত।শশধর আর ওর বাবাও যে কখনও জমি জিরেতে কাজ করেনি তা নয়।পূর্বে মালো আর কৈবর্তর ভিতর বিয়ের সন্মন্ধ ছিলো অসম্ভব।আজকাল সামাজিক নিয়ম নীতিগুলোয় অনেকটাই শিথিলতা এসেছে।শৈলবালার ছোটবোন গিরিবালারও তো পালটি ঘরে বিয়ে হয়নি।

ভোঁদড়গুলো ততক্ষনে ওদের  ধারাল নখরযুক্ত হাঁসের পায়ের পাতার মত পা দিয়ে হাঁচড় পাঁচড় করে মাটি খুঁড়ে উচ্চিংড়ে বার করে উদরপূর্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।তিন চার কেজি ওজনের হাত খানেক লম্বা ভোঁদড় যখন শিকার ধরার জন্য ছুটাছুটি করে  শৈলবালা তখন রীতিমত হিমসিম খায় ওদের সামলাতে।ঘর্মাক্ত শরীরে ও ভোঁদড়গুলোর গলায় বাঁধা রশিটা টেনে ধরে রাখে।

এতক্ষন শৈলবালা খেয়াল করে নি পশ্চিমের বাঁশ ঝাড়টার গোড়ায় নিকারি সামসুর লম্পট ছেলেটা গলায় লাল একটা মাফলার জড়িয়ে ওর দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।চিন্তার জাল ছিঁড়ে শূণ্যে দৃষ্টি রেখে শৈলবালা স্বগতোক্তি করে,আঃ মরণ আমার!ঝাঁটামারি পোড়ামুখে।নিকারি সামসু নিপাট ভালো মানুষ।শশধরের কাছ থেকে সস্তায় মাছ কিনে নেয় বটে,কিন্তু আর সব ভালো।বিপদে আপদে সুদবিহীন টাকা কর্জ দেয়। বাগানের কলাটা,মূলোটা দেয় কাকিমা মাঝে মধ্যে বিনিপয়সায়।আর এদিকে সামসু কাকার হতচ্ছাড়া ব্যাটা হাড়ে মজ্জায়একটা শয়তান।

শশধর গেছে দলের সাথে সুন্দর বনের গহীন জংগলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাটির চিত্রা নদীতে ভোঁদড়বিহীন মাছ ধরতে । সে এক অন্য পদ্ধতি।পাক্কা দশদিনের ধাক্কা আসা যাওয়ায়।শশধর বলে গেছে,শৈল আমার তো সময় লাগবে। তোমরা সাবধানে থাইক।পোলাটার দিকে খেয়াল রাইখ।কুমির নাকি দেখা যাইতেছে গাঙের ধারে কাছেও।ধাইরা গুলারে ঠিক মত খাইতে দিও।আজ সে ফিরবে প্রায় অপসৃয়মান সূর্য যখন পাটে নামবে তখন।

বড় নৌকায় শশধর,বিমল,রবীন,হাবলু ,রহিম শেখ আর জালালউদ্দিন গেছে।বড় ভারী নৌকা,ওটা সামলে মাছ ধরার কাজ করতে এতগুলো লোকেরই দরকার।নদী যেখানে খাঁড়ি মত হয়ে গেছে,দু'পাশে ঘন সবুজ বন ঝুঁকে পড়ে পরস্পরকে চু্ম্বনের চেষ্টায় ব্যাপৃত ;সেখানে গিয়ে ওরা বাস গাড়ে।সে আর এক গল্প।পরে আাসা যাবে।

ৰেশ কয়েকটা কাঁকড়া যখন খাওয়া হয়ে গেল ভোঁদড়গুলোর, তখন ফিরতে  মনস্থ করল শৈলবালা। নাম ধরে ডাকল ভোঁদড়গুলোকে এ্যাঁকা!ব্যাঁকা! চল্ চল্,অনেক হয়েছে,এবার ঘরে চল্।পুরুষ দুটো ভোঁদরকে ওরা এ নামেই ডাকে।ওদের সর্ব সমেত, পুরুষ আর স্ত্রী মিলে চারটে ভোঁদড়।স্ত্রী ভোঁদড় জিকা এখন গর্ভবতী ক'দিনের ভেতরই বাচ্চা হবে দু'টো কি তিনটে। সব ভোঁদড়েরই গায়ের তেলতেলে ঘন লোম হাল্কা বাদামি রংএর কখনও বা কুচকুচে কালো,গলা আর পেটের দিকটা সাদাটে।স্তন্যপায়ী  জন্তুগুলো শৈলবালার ডাকে বুঝতে পারে ওদের এখন ফিরতে হবে।গলায় বাঁধা রশিতে টান পড়ে। রশিটা বুকের নীচে দিয়ে সামনের দু পায়ের জংঘা সন্ধি বেড় করে গলার সাথে বাঁধা থাকে।তাই ভোঁদড়গুলোকে জেলেরা সামলাতেও পারে আর রশির ঘষায় ওদের গলাও ক্ষত- বিক্ষতহয় না। ওরা এখন ঘরমুখি
  । ওদের তীক্ষ্ন চীৎকারে কান ঝালাপালা  হয়ে যাওয়ার যোগাড়। ঘরের পেছনে স্যাঁতস্যাঁতে  ঘন ঝোপের তলায় জিকা গাছের গুঁড়ির সাথে ওগুলোকে বেঁধে শৈল যাবে নদী পাড়ে।এই জিকা গাছটার তলায়  মাদি ভোঁদড় জিকার জন্ম হয়েছিলো। নদীর জলে একেবারে কিনার ঘেঁষে জল-কলমি আর টোপা পানার ঝাড়ের ভিতর পাতা কুঁড়ো জাল থেকে শৈল  কুচোমাছ যা দু'চারটে পাওয়া যায় তুলে আনবে। ইন্দুমতি -শৈলর পিস-শাশুড়ি তখন দুধ নিয়ে বিলি করতে যাচ্ছে মুসলমান পাড়ায়। সে সেখানে নিকারি সামসু মিঞা আর সাহেদ মাষ্টারের বাড়ীতে কখনও পোয়াখানেক কখনও বা আধসের আন্দাজ দুধ দেয়।কখনও বা পাঁচমিশালি শাক নিয়ে গেলেও দুটো পয়সা জোটে।বিত্তবান সামসু বা সাহেেদের স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা এগুলো খুব পছন্দ করে।

আগামীকাল শশধর বেরুবে ভোঁদড় নিয়ে।অনেকদিন ধরে ওর নৌকাটা একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কাদের আসবে নৌকা নিয়ে নদী পাড়ে।এবার সংগী  হবে মুন্সি, গৌরাঞ্গ আর রন্জন।ওরা স্থির করেছে সন্ধ্যায় যখন আযান দেবে আর শাঁখ বাজবে ওরাও তখন যাত্রা শুরু করবে।সন্ধ্যার পর থেকে মাছ বেশী বেশী পাওয়া যায় কে না জানে!বিকেলে শশধর,গৌরাংগ আর রন্জন পূজো দেবে নদী ঘাটে।প্রতি বারই ওরা পূজো দেয় এবার যাবে চিত্রা নদীর বেশ গভীরে,তাই এবার ঘটা একটু বেশী।কালু রায়ের পূজো।কালু রায় কুমির দেবতা।তাকে সন্তুষ্ট করলে কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এই ওদের পরম বিশ্বাস।

শৈলবালা সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছে। রাংতায় মোড়ানো মাটির ঢাল-তলোয়ার,তীর-ধনুক আর টকটকে লাল পোশাকে মাটির ঠাকুর এখন একেবারে যুদ্ধ দেবতা।কাঁসার থালায় বনঝাউ,মুড়কি আর একটু শুকনো খই এর নৈবদ্য সাজিয়ে শৈলবালা এল বড় অশথ্থ গাছের নীচে বেদীর কাছে।শৈলবালার ছেলে জয়ন্ত বাবার রাতে খাবার জন্য এনেছে চিড়ে,মর্তমান কলা আর বোতলে একটু গাই দুধ।পিসী ইন্দুমতি বড় যত্নের সাথে সব গুছিয়ে দিয়েছে।শশধর আর শৈলবালা নৌকার অপেক্ষায়।শশধর বলল,বউ এভাবে তো আর চলে না।আগে  বাড়ীর ধারেকাছে নদীর কিনারায় মাছ মারতে গেলে কিছু মাছ,কাঁকড়া পাইতাম।এখন যে কি আকাল লাগছে!নিরুপায় শৈল খসখসে, কর্কশ হাতটা চিন্তিত স্বামীর পিঠের উপর রাখে, সহমর্মিতা জানায়।খুব মন খারাপ করলে, বা আনন্দিত হলে এক কথায় আবেগ তাড়িত হলে শশধর শৈলবালাকে 'বউ' বলে সম্বোন্ধন করে।ভোঁদড় গুলোর খাবার জুটাবো কোথা থেকে,মাছই তো ধরা পড়ে  না সে পরিমাণ।নৌকাটাও মেরামত করতে পারি না,পোলাপানরে কি খাওয়াব ,কি পিন্ধাব।দিশা পাইনা বউ।শশধরের অসহায় কথাগুলো আর্তনাদের মত শোনায়।শৈলবালার কপালেও চিন্তার দু'টো তাৎক্ষণিক ভাঁজ পড়ে।দৈন্যতা আর অনিশ্চয়তা ওদের বয়সের তুলনায় অনেক বুড়িয়ে দিয়েছে।


ওদিকে কাদের আর মুন্সি ওদের পাড়ার মসজিদে মিলাদ পড়িয়েছে।সামান্যই আয়োজন, মসজিদে উপস্থিত জনের মাঝে বাতাসা বিতরণ।আয়োজন যাই হোক না কেন প্রার্থনা তো অন্তরের গভীর কন্দর হতে!গত সপ্তায় এক মালো জেলে গেছে কুমিরের উদরে।ওরা সবাই রওয়ানা হবে অতি শীঘ্রই। কাদেরের স্ত্রী জোহরা আর ছোট ছেলেটা এসেছিলো ঘাট পর্যন্ত কাদেরকে বিদায় দিতে।ছেলেটার প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে,পোয়াতি বউটারও পরণে বিবর্ণ, ছিন্নপ্রায় শাড়ী।ছ'ছটা ছেলেপিলের বাপ কাদের ।নাঃ এবার ফিরে এসে ও বন্ধ্যাকরন করাবে, মোল্লাদের কুযুক্তিতে ভুলবে না,ভাবে কাদের। ভগ্নপ্রায় হীনস্বাস্থ্য বউটার দিকে চাওয়া যায় না। ।ওর খাবার এসেছে বাড়ী থেকে। একটুখানি মলা মাছের চচ্চড়ি খূব ঝাল করে রান্না। জোহরা রাঁধে ভালো,যেন অমৃত-- কাদেরের নিজস্ব মূল্যায়ন। মুন্সি সদ্য বউ তালাক দিয়েছে।বৃদ্ধ বাবা স্ত্রীর রান্না করা শুটকি-বেগুনের তরকারি আর মোটা চালের ভাত,এককোণে দু'টো কাঁচামরিচ দিয়ে সাজিয়ে ছোট টিফিন বাটিতে করে এনেছে ছেলে মুন্সির জন্যে।গৌরাংগ আর রন্জনও রাতের খাবার এনেছে বাড়ী থেকে।

ভোঁদড়ের বাক্স তোলা হলো নৌকায়। চার ফালা করে কাটা মোটা বাঁশের ফালি পাশাপাশি বেঁধে বানানো বাক্স,ডালাটা উপর দিকে খোলা যায়।একজোড়া ভোঁদড় শশধরের আর একজোড়া মুন্সির।ভোদড়গুলোকে রাখা হয়েছে এই বাক্সটার ভিতর। শশধরের জিকা নামে ভোঁদড়টা আজ কালের ভিতর বাচ্চা বিয়াবে তাই জোড়াটাকে রেখে আসতে হলো বাড়ীতে। এবারের বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটে খানিক বড় হলেই  আনিসের কাছে  বিক্রি করবে,কড়ার হয়েই রয়েছে। বাচ্চা ভোঁদড়গুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শশধর মাছ ধরা শিখাবে। ভোঁদড় প্রশিক্ষণের কৌশল তো আর সবাই জানেনা ।এ বাবদও বেশ কিছু নগদ আসবে হাতে।

 মাছ বিক্রির টাকা আনুপাতিক হারে বন্টন হবে ওদের সবার মধ্যে। সিংহভাগ পাবে কাদের মিঞা। এর পরের বড় অংশ হবে শশধরের, ও যে মাছ ধরার জাল আর দু'টো ভোঁদড়ের মালিক।সবকিছু তোলা হলো নৌকায়। এক কলসী পানিও নিতে ভুলল না ওরা।শশধর ত্রিকোণাকৃতি জালটার বাঁশের তৈরী একবাহু  ভালো করে বাঁধল লম্বালম্বি করে নৌকার একপাশে।ঐ মুন্সি মজবুত কইরা বাঁধ্ দে।গাযে জোর নাই নাকিরে?শশধর বলে,। বাকি আড়াআড়ি করে বাঁধা দুটো বাঁশের সাথে আটকানো জাল ধরে থাকবে শশধর আর রন্জন।আর  বৈঠায় থাকবে কাদের, ওর নাও  সুতরাং কর্তৃত্ব আর আয়েস তো ওই উপভোগ করবে।লগি নিয়ে দাঁড়াবে মুন্সি।গৌরাংগও থাকবে লগি হাতে।সব কিছু তোলা হলো। লাল সূর্য অস্ত যায় যায়।ওরা সবাই উঠল নৌকায়।শৈলবালা শাঁখ বাজাল,কাদের পশ্চিমমুখো হয়ে আজান দেওয়ার সাথে সাথে ওরা নৌকা ভাসাল নদীতে।
 ভোঁদড় গুলোর চীৎকারে তিষ্ঠানো দায়। খানিক অগ্রসর হওয়ার  পর ওরা ভোঁদড়গুলোকে পেট পুরে খেতে দিল কাঁচা মাছের কাঁটা,কানসা, ফুলকো,লেজ আর ভালো ক'খানা টুকরো।পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে আকাশে, নদীর কাজল কালো জলে চাঁদের ছায়া খানখান হয়ে ভেংগে পড়ছে।কি মোহনীয় রহস্যময়,গা ছম্  ছম্ করা রোমান্চকর,সৌন্দর্যমন্ডিত বেদনা-বিধূর পরিবেশ। দূরে আঁধার নেমে আসা গ্রামগুলোয় মিটিমিটি করে জ্বলছে দু' একটা প্রদীপ।রন্জনের ভরাট গলার মন কেমন করা গানে সবাই উদাস হলো।অবচেতন হৃদয়ের গোপন ভালবাসা,বাস্তব জীবনের প্রেম,স্ত্রী পুত্র কন্যা পরিজনের জন্য মমতা হাহাকার করে উঠল। ওরা অগ্রসর  হচ্ছে ক্রমশ যেন বিভীষিকার দিকে।

মাছ ধরাই ওদের জীবিকা।বিশেষ করে আরও অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের  মৎস্য-জীবির মতই এটি মালোেদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ব্যবসা এবং এটিকে ওরা পূত-পবিত্র  ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করে।সভ্যতার বিবর্তন,জীবনধারণের ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও মান বৃদ্ধি আর শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে আজ পেশার পরিবর্তন হচ্ছে । শশধর,রন্জন,গৌরাংগর মতো নড়াইল, খুলনার অনেক মালো মৎস্য শিকার এবং ভোঁদড় ব্যবহারে উৎসাহ হারাচ্ছে।অনেক মুসলমান জেলে আজ শশধরের  মতই ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করে। এত সমস্যা তবুও শশধরের বর্তমান জীবিকা থেকে সরে আসতে মন চায় না ।সেই কোন্ শৈশব থেকে বাবা-কাকাদের সাথে কালে ভদ্রে ঠাকুরদার সাথেও শশধর ভোঁদড় নিয়ে মাছ ধরতে গেছে।জল,জলজ প্রকৃতি আর মাছের সাথে,মাছ ধরার নিবিড় কৌশলের যে এক মাদকতা ওর রক্তে এবং হাজারো জাত জেলের রক্তে তা তারা এড়িয়ে যাওয়া কি এতই সহজ।কি এক উন্মাদনা হাতছানি দেয় অহরহ।

অনকখানি ভাটির দিকে আগিয়েছে নৌকা।ওরা গলায় রশি বাঁধা ভোঁদড়ের বাক্সের ঢাকনা খোলার সাথে সাথে বোঁটকা গন্ধের ভোঁদড় চারটে বেরিয়ে এলো।ওদের জলে নামিয়ে দিয়ে সবার অপেক্ষা কখন মাছ ধরা পড়বে জালে। প্রশিক্ষিত ভোঁদড়গুলো দ্রুত সাঁতরে,তাড়িয়ে নিয়ে আসে জালের দিকে দিশেহারা মাছের দলকে।উত্তেজিত রন্জন বলে,দাদা কিবা মনে হয়।অন্ধকারে আনন্দোজ্বল শশধরের  চকচকে চোখ না দেখতে না পেলেও ওর ভাষায় যা বোঝার রন্জন বুঝে নেয়।শুধু কি রন্জন আর শশধর, নৌকার সবাই বোঝে আজ ভাগ্য সুপ্রসন্ন।শশধরের ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার অভিঞ্জতা অনক সমৃদ্ধ।তিন বারের জালেই প্রচুর মাছ পাওয়া গেছে।নৌকার পেটের খোলে মাছগুলো খল বল করছে।দুটো মাঝারি আকৃতির চিতল আর পাঁচটা বোয়ালও ধরা পড়েছে,আর ছোট মাছ, সেতো বেশুমার।পূর্ণিমার রাতে মাছও জলকেলি করতে পছন্দ করে শশধর  জানে আর তাই এটি মাছ ধরার উপযুক্ত সময়।

শশধর বলে,কাদের ভাই নাওটা আর এট্টু ভাটির দিকে লন,ওইখানে যেখানে নল-খাগড়ার বড় ঝোপ, ঔখানে তিন চারটা জাল মারব,তারপর আর চিন্তা নাই। খিদা পাইছে কাদের ভাই,আমি দুইটা খায়া নেই।খাওয়ার মাঝখানেই ও চিন্তাপ্লুত হয়।মাথা ঝাঁকিয়ে আপন মনেই ভাবতে থাকে..আসছিলো তো শহর থেকে কত সাহব-সুবো।কত কথা কয়া গেল,ছবি নিল।সুন্দর সব্বড় মাপের কথা কিছু শশধরা বুঝল কিছু বা না।কত স্তোক দিয়া গেল,তরপর যে লাউ সেই কদুই।কাপড়ের খুঁটে মুখ মুছল শশ।

বুভুক্ষ ভোঁদড়গুলোকে শিকার করা কুচো চিঁংড়ি,তিত্ পুঁটি আর কাঁকড়া দিলে মহানন্দে তীক্ষ্ন চীৎকার করতে করতে সবই খেয়ে নিল।

নৌকার ছইএর নীচে বসে কাদের আর মুন্সি ওদের মুখরোচক খাদ্য খাচ্ছে হাপুস-হুপুস করে।গৌরাংগ হাল ধরেছে।ওরা সবাই আনন্দিত। রন্জন এবার  গান ধরে আনন্দের।সবাই পুলকিত।কাদের ভুড়ুক ভুড়ুক করে তামাক টানে।

সবার খাওয়া শেষ হলো। শ্রান্ত চাঁদ আকাশের দেয়ালে হেলান দিয়েছে।ওরা  নলখাগড়ার কাছাকাছি এসে জাল নামাল,ভোঁদড়গুলো ঝপাং করে পানিতে নামল।ওরা তড়িৎগতিতে বনে ঢুকল।তাড়িয়ে নিয়ে মাছগুলোকে ঠেলে পাঠালো জালের ভিতর।রন্জন আর শশধর জাল টেনে উঠালে অতি উৎসাহি রন্জন,গৌরাংগ আর মুন্সি চীৎকার করে উঠল আনন্দে।কাদের বলে উঠল কিরে কি মাছ!আরে দেখেন না এদিকে আইসা। কাদেরের আর আসতে
হলো না,প্রচণ্ড এক টালমাটাল ধাক্কায় ওরা কে যে কোথায় ছিটকে পড়ল।শশধর নলখাগড়ার বিশাল ঘন ঝোপের ভিতর পড়ে সম্বিৎ হারাল।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন সকাল হবো হবো,সমস্ত শরীরে আর একটা চোখে প্রচন্ড ব্যথা।ধীরে ধীরে নলখাগড়ার বন সরিয়ে সে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল।চারপাশে ঘনঝোপ,বোধহয় কোন বসতি নেই ।সংগী -সাথি মায় নৌকাটার পর্যন্ত হদিস নেই।রশিবাঁধা ভোঁদড়গুলোরও দেখা নাই।ওর মনে পড়ল পানির দিকে ঝুঁকে ও দলবদ্ধ মাছের সারি দেখছিলো,নলখাগড়ার এক্কেবারে কাছাকাছি।হঠাৎ প্রচন্ড এক ধাক্কায় ঝপাস করে নলখাগড়ার  ভিতর জলে পড়ল।জলের  ভিতর প্রচন্ড আলোড়নের শব্দে তার অবচেতন মন বিপদের সংকেত পেল।অতি দ্রুততার সাথে সে হাচড়-পাঁচড় করে ধারাল খোঁচা খোঁচা নল-খাগড়ার ঝোপের ভিতর ঢুকে গেল।তারপর আর কিছু তার মনে নেই।

শশধর খুব ঘামছিলো।প্রচন্ড গরম আর  ক্লান্তি অনুভবে সে ভিজে লুংগির খুঁটটা দিয়ে মুখ মুছল।তার বাঁ দিকের গাল বেয়ে  একটা লোহিত ধারা নেমে মিশে গেছে,তার কর্দমাক্ত শরীরে।ফোলা বাম চোখটা বন্ধ এবং প্রচন্ড বেদনায় টনটন করছে।ওর নিজ স্ত্রী- পরিজনের কাছে ফিরতে হবে।ফিরতে হবে আপনার  ক্ষুদ্র 'বাবুই' কুন্জে।কাছেই রন্জন পড়ে আছে নিথর নিস্পন্দ।

Wednesday 1 June 2016

Unsung gone Sudha..

Sudha, Selim and Tahir were friends. They were friends since their very early childhood. Sudha and those two boys lived in the same locality. They were neighbours. Sudha and Tahir's houses were adjacent to each other while Selim lived in a house of may be few hundred feet down the road. They used to play together, sing together and even fight together like every other teenagers. While they had few other companions but the bonding between these three was very remarkable.

The surrounding atmosphere in those days was very calm and quite and very peaceful. Numbers of trees with plentiful fruits and flowers were the prime attraction for the children. During the summer, monsoon and winter Selim and Tahir along with other friends used to climb up the trees and pluck fruits. Sudha used to get the lion's share of every fruits and flowers collected by the them. These two boys also felt a kind of affection for Sudha. Their days was filled with laughter and merry making round the year and their days were happily passing by.

Time kept on passing rather quickly. Sudha, Selim and Tahir and all of their other friends stepped into their youth. Some stopped studying while some others continued like the three main characters of this story. Sudha and Selim got them selves admitted into the university while Tahir chose college for a polytechnic study.

As the years went by Sudha, Selim and Tahir's friendship with other boys and girls gradually became minimal but the bond between these three friends remained as strong as it was before. Eventually, Selim and Sudha were elected general secretary and cultural secretary in their university student's forum.

Sudha and Selim were from a middle class family. Sudha's father was a school teacher and Selim's a publisher while Tahir's father used to look after family owned businesses which seemed to be always flourishing. There existed a good relationship among the three families too in spite of the economical differences.

Then little by little clouds started rolling in and covering up the otherwise peaceful blue sky. An uproar of citizens from all walks of life started against the then Pakistan government in power. Very regularly students started going for picketing and public processions. One day from one such procession police arrested Selim and sent him to jail on charges of treason as Selim was vocal against the oppression and discrimination done by the government.

Selim faced a traumatic period in jail being subjected to inhuman torture and countless interrogations. Only on few occasions the jail authorities permitted Sudha to visit Selim. She used to feel sad and depressed seeing the visible torture marks and scars on Selim. On one occasion she asked Tahir, if he would like to visit Selim but he denied with a lame excuse of work. She felt that Tahir had changed but she could not comprehend the reason.

One day, Tahir returned a book to Sudha that he had borrowed earlier on. As she was about to shelf the book, an envelop slipped out from inside and fell to the floor. The envelop was secretly tucked inside the pages. She picked up the envelop and opened. To her surprise she found a letter from Tahir.. a love letter! Sudha's life at that point was fully encumbered by student politics in a turmoiled time. The letter didn't carry much of a meaning to her and she sort of felt a disinterest in the love letter and Tahir. She put the letter in her drawer and never spoken about it and never did she express her feelings or speak of this matter to Tahir or anyone.

Eventually Selim was released from jail under general amnesty from the government. But in the greater political arena the people's movement and demands kept on going unheeded. On one fateful night the government unleashed its military might on ordinary people with brutal savagery.. The country headed for war.. A war for Independence.A war for the independence of the country  namely Bangladesh. An armed war to free the country from foreign ruler and to establish a sovereign country.. where people will have freedom.. Freedom of expression and freedom of using their mother tongue. People from all walks of life revolted and joined the pro-liberation forces. As the war unfolded its bloody chapters a group of Bengali people betrayed their own brothers and started working with the then government of Pakistan and formed a militia whose job was to hunt down and kill supporters and sympathizers of the pro-liberation forces.

Few weeks after the start of the war Selim secretly left home to join the freedom fighters. His agenda was such a secret that he did not even reveal this to Sudha.  It happened to be few days before Sudha's birthday. Before going out on his secret mission he met up with her and gave a beautiful small box as a birthday present, telling her not to open that before her birthday. Inside was a blue envelop laid along with some Spanish cherry.. another love letter for Sudha!

Selim wrote as Sudha read through: 'Sudha my dear, Forgive me, I could not inform you earlier as I was in a haste to leave this place and join the freedom fighters training camp. After the training I will fight shoulder to shoulder with my comrades to fly the flag of our independent country. I promise I will fight till my last breath and till my last blood drop. Last of all I want to say Sudha, I love you. Your memories will inspire me to reach my goal. I promise I will be back in a sovereign country. After I come back I dream to build a home of our own. Together we will work hand in hand to rebuild our new born nation. I hope I will be able to conquer your heart by this time'.

Sudha broke down in tears, firstly tears of joy of feeling loved and next she felt scared about the fate of Selim. She thought about the dangers Selim has put himself in.. he may not come back alive. She realized she also actually subconsciously loved Selim but only she didn't know it. The letter had dug out her love. Sudha preserved the letter carefully.

During the war the Pakistani army and the militia was jointly taking part in rampant killing, arson and looting all through out the country. Savagely trying to wipe out the desires of freedom from all Bengali people. Town after town came under blitzkrieg, village after village was wiped out. Out of fear millions of people left their dwellings and marched to neighboring country as asylum seekers. On that fateful day Sudha's neighborhood was rocked by the sounds of military trucks, gunfires and screams. Houses of Selim and Sudha were set ablaze. Sudha's mother an woman of fifty was taken as prisoner to the army camp and her father mercilessly beaten and stabbed with bayonets till he breathed his last. The gang of militia and army was led by a young man wearing a face cover. She was shocked to recognize his eyes.. those eyes she knew since her childhood.. it was none other than Tahir! Sudha was taken forcibly to Tahir's house.

Sudha was held captive at Tahir's house. Everyday Tahir would talk to her and try get her to consent to his marriage proposal. First few weeks Sudha was depressed to the point that she thought of committing suicide. As she settled down further in her current situation she thought she could do something for her motherland and at the same time also punish the traitor Tahir. Sudha agreed to his marriage proposal..

Months passed by while Sudha kept busy creating her image as a devoted wife to earn Tahir's trust. It appeared that she had surrendered to Tahir and accepted her fate. Nevertheless Sudha secretly used to maintain liaison and communication with an informer working for the liberation force to get news of Selim. Another few months later, one day in the month of November she hatched her plan. It was Tahir's birthday and she said to her husband that she wanted to cook some special meal on his birthday occasion. She requested him to send grocery home from the local grocer named Malek mia.

That night, while Tahir was busy listening to the news, very quietly through the back door left opened by Sudha entered some nine or ten freedom fighters in Tahir's house. There was no resistance from any of the guards, they appeared to be either unconscious or in deep sleep. They took possession of the store room and the arms and ammunitions stored there in. Then silently four men crawled up the staircases as shadows while others remained at the courtyard guarding the entrances. All of their guns were loaded and raring to go off at seconds notice.

The assault team took position in front of the door. As they were taking preparation to ram the door open, they noticed the door moved a bit. They froze and then sighed in relief as they realized the door was open. Time to time it moved whenever some breeze comes in. As planned they dashed inside with guns pointing forward ready to shoot. They came to a shock!  There was three bodies lying scattered on the floor: a man and a woman and that of an elderly lady.

They were confused and puzzled at what happened. They came to raid the house and kill Tahir, the traitor behind many armed assaults and murders of ordinary people in that area. As per information from their informer that night was Tahir's birthday and he would be at home...

As promised Selim had returned to an independent country Bangladesh. He later received medal of honor as a valiant fighter and his name is uttered even today like many other freedom fighters. But nobody knew how Sudha breathed her last until Selim met Malek, the grocer of the area..

"I know what might have happened.. I am Malek the informer and local grocer. That night Sudha cooked very delicious food together. She spiked her recipe of spicy yogurt drink with other 'very special' ingredient obtained from me. I do not know how she died but all she told me is that she was going to kill Tahir with the poison. Whether she drank willfully or she was forced to drink under circumstances to execute her plan that we may never know. But she successfully carried out the plot as the armed guards of Tahir's house was also found dead. Our comrades raided the house without any resistance at all."

Selim appeared to be shell shocked as if the whole world was crumbling down on him. He could hear Malek's voices coming from a far..
 
".. I buried her in the quietness of the bushes where you all used to play when you were young. I was the only one to offer a prayer as nobody volunteered in the burial"

Sudha started her eternal journey unwept and unsung. In no history her name was depicted as a soldier of liberation.

ত্রাস

অনবরত একটা ত্রাস মালেককে  তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সে জানেনা কবে  সে মুক্তি পাবে এর হাত থেকে।মুক্তি তার চাই -ই  চাই।কিন্তু সে জানে না সে মু্ক্তি কি ভাবে আসবে। কখন আসবে।কে সে নমস্য ব্যক্তি যে তাকে মুক্তি দেবে।কিন্তু  মুক্তি যে তার চাওয়া।এভাবে কেঁচোর মত বেঁঢে থাকা।সে দুমুঠো কম খেয়ে হলেও নিষ্কৃতি চায়।দুর্যোগ,ভয় নিরাশা তাকে এই বয়সেই অনেক
ভাবতে শিখিয়েছে।

 শৈশবএর কটি বছর কেটেছিলো নিশ্চিন্তে।
 ফর্সা সোনালী  পূর্নিমার চাঁদের মত  মুখ ছিল মায়ের। ঝকঝকে ফর্সা নীল কাঁচের চুড়ি  পরা দুটি হাত পরম মমতায় ওকে স্নান করিয়ে দিত।অবশেষে ভেজা কাপড়ের উপরে একখানা গামছা জড়িয়ে ওর হাত ধরত।
এক পাঁজা মাজা বাসন কোসন থাকত আর এক কাঁখে।কোমরে কালো ঘুনসির সাথে বাঁধা থাকত একটি ঘুঙুর । শুধু কি ঘুঙুর, ঘুনসির সাথে আরো বাঁধা ছিল একটা ধপধপে সাদা কড়ি আর একটা ফুটো পিতলের পয়সা।ওটি নাকি পাকিস্তানি আমলের' হয়সা'।  ওর দাদী বলত।এ দুটি ছিল অমঙ্গল আর অশরীরী অশুভ আত্মা থেকে রক্ষার রক্ষাকবজ। ন্যাংটো  দিগম্বর সে এগুতো  মাযের  সাথে সাথে। হাঁটার  তালে তালে কোমরে  কালো ঘুনসির সাথে বাঁধা  ঘুঙুরটি বাজত টুং টুং ..টুং টুং। পাছে খেলতে খেলতে সে দুরে কোথাও চলে যায়..মা আর দাদী তাই সাবধানতায় সবসময় তার ঘুনসির ঘুঙুরের আওয়াজ এর দিকে কান পেতে থাকত।। 


তার বাবার কোনো স্মৃতি তার কাছে নেই। ভালবাসা স্নেহ আলিঙ্গন কিছু স্মরণ পড়ে না তার। শুধু ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে কেউ একজন দোকানে নিয়ে একদিন একটা লাবেন্চুস কিনে দিয়েছিল। মা মাঝে মাঝে থম মেরে বসে থাকত। ওর  তখন বড় খারাপ লাগত। সেদিন গুলোয়  দাদী রান্না বাড়া সব করত। আর গজ গজ করত,পুংটা পুলাডা মরেও না। কারা সব লোকজন আসত। কেমন যেন লোকগুলো। দাদির প্রায় পড় পড়  ঘরটায় যেয়ে হই-হল্লা করত। দাদী ঘরের ভিতর গুমসাতো,মর মর  অলাউডা  হইয়া মর্। মা ঘরের কোনে জড়-সড়  হয়ে বসে  থাকত। 'হারামজাদা মরেও না।মরলে হিণ্ণি দিমু মাজারে'।
মা তখনও ওকে ঘসে মেজে চকচকে করে রাখত।
বড় হবার পর,ওর বাবা মারা যাবার পর ওর মা ওকে গল্প বলত। তার জীবনের গল্প। গল্প বলার সময় মা যেন কোথায়  হারিয়ে যেত। শুনেছিল ভাগ্যান্বেষণে দাদা তার যৌবনকালে সরিষা বাড়ি থেকে ময়মনসিং এর  জামালপুরে আসে স্ত্রীর হাত ধরে। জীবিকায় ছিল একজন দর্জি। সবাই ডাকত 'হ্যালাল' খলিফা বলে। হেলাল এর স্ত্রী হনুফা ছিল বুদ্ধিমতি আর সহনশীল। সংসারে উন্নতি হতে থাকলো,ওরা দুজন কিছু জমি জিরেত ও করলো। সংসারে এলো স্বচ্ছলতা আর সুখ।ছোট সংসার তিনজনের-  হেলাল,হনুফা আর ওদের একমাত্র ছেলে কাসেম। কিন্তু বিধি বাম।

 খলিফাও মরলো সংসারে ও ভাঙ্গন ধরল। আস্তে আস্তে হনুফার ছেলে বিগড়ে যেতে থাকলো।পাড়ার বদ ছেলে পিলেদের  সঙ্গে মিশে এ হেন কু কর্ম নাই  যাতে সে  লিপ্ত হলো না।রাগ,বকা ঝকা কোনো কিছু করেই ছেলে কাসেম কে ফিরতে পারল না হনুফা।কাসেম এর উত্পাত ক্রমশ বেড়েই চলল। আমারে গাং এ ভাসাইয়া  দিয়া ব্যাডা মাটির তলে হান্দাইছে,গতপ্রান স্বামীর ওপর অভিমান করে হনুফা স্বগোত্উক্তি করত।উপায়ান্তর না পেয়ে চিরাচরিত বাঙালি মায়ের পথই অনুসরণ করবে বলে মনস্থির করলো হনুফা।
ভাবলো নিশ্চয়ই সুন্দরী বউ ঘরে আসলে কাসেম এর মন গৃহমুখী হবে..কিন্তু ততদিনে কাসেম হয়ে গেছে 'কাসু গুন্ডা' ।বিকৃত করে কেউ কেউ বলে 'কাইসসা গুন্ডা'।অবশেষে কাইসসা গুন্ডার মা সুন্দরী  মেয়ের খোঁজ পেলেন।  ইসলামপুরে হত দরিদ্র  বাপ মাযের ঘর আলো  করা রূপসী মেয়ে। হনুফা আর দেরী না করে তড়ি ঘড়ি বউ নিয়ে এলেন ঘরে। মেয়ে আবার নাকি ইস্কুলেও পড়েছে পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত।
বিয়ের সময় মা লক্ষ্য করলেন ছেলের চোখে মুগ্ধতা। মুখ টিপে হাসলো হনুফা।এইবার ছেলে জব্দ। সারাদিন বৌএর আঁচল ধরে ধরেই ঘুরবে। তাতে আপত্তি কি!এটাই তো তার চাওয়া। সোনার ছেলে কাসেম ঘরমুখী হবে। ভাগ্যদেবী তখন মুচকি মুচকি হাসছে।  মাত্র বোধহয় চার কি পাঁচ দিন। এর ভিতরেই কাসেমের চোখের ঘোর  কেটে গেল। বেরিয়ে গেল বন্ধুদের সাথে। ফিরল পাঁড় মাতাল হয়ে। খিস্তি-খেউর করে সোহাগী আর হনুফার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ল। কাসেমের বর্বর দাবির মুখে ভেসে গেল জমি-জিরেত। সর্বকালের মত লোভী স্বার্থাণ্বেষি মহল তো সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো এবার তারা এর সদ্বব্যবহার করতে দ্বিধা করল না।

  
সেই শুরু হলো তা আর থামল না কোনদিন যতদিন না..
কাসেম পোশাক চরিত্র দুইই পাল্টে ফেলল ।তার পরনে এখন, চকরা -বকরা রং-চং এ সার্ট। গলায় লাল সিল্কের রুমাল। ডান  হাতের  আঙ্গুলে রুপো  বাঁধানো সবুজ পাথরের আংটি । সবাই জানে ওই হাতের এক ঘুষিতে কাসেম গাল মুখ ফাটিয়ে দিতে পারে। কোমরে গুঁজে রাখে দুমুখো স্প্রিং এর ছুরি । গায়ে ভুরভুর করে সস্তা সুগন্ধি।ঘরে ঢুকেই খিস্তি শুরু করে দেয়,
ওই ফহিন্নির মাইয়া  ফহিন্নি জলদি বাত দে। ওই মা তুই মরছস নি। ট্যাকা বাইর কর ।জলদি কর ক'লম। ঘরে ক'লম আগুন লাগাইয়া দিমু। ভয়ে সুড় সুড় করে টাকা বের করে দিত হনুফা। আর পুত্রের মৃত্যু কামনা করত। ততদিনে সোহাগীর ঔরসে মালেকের জন্ম হয়েছে।প্রথম কদিনের সোহাগির সাথে রাত্রি যাপনে মালেক বীজ বপন করেছে। মালেকের জন্মের পর বলে, কই থাইক্কা পেট বাজাইয়া বাচ্চা পয়দা করলি। হালি নডি। মা যে কই থেইকা ধইরা আনছে বেশ্যাটারে ।
সোহাগী আর হনুফা বাচ্চাটাকে লুকিয়ে রাখে। কাসেম এর সামনা-সামনি হতে দেয় না। তবুও কবে যেন একদিন কাসেমের সামনে পড়ে  গেল মালেক। 
এত সুন্দর ! এত সুন্দর শিশু! এটি  নাকি তার সন্তান। বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো।তখনতার বছর দেড়েকের মত বয়স।
এত সুন্দর ! এত সুন্দর ফেরেশ্তার মত !ফেরেশস্তা দেখতে কেমন কাসু জানে না।তবে মনের গহীন কোণে তো এমন ছবিই আঁকা। এটি তার সন্তান! বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো। আরো একদিন কাসু গুন্ডার সামনা সামনি পড়ে গেল মলি ওরফে মালেক ।সোহাগী আদর করে এ নামেই তাকে ডাকে। কাসেম ডাকে কাছে। হনুফা আর সোহাগী ঘরের ভিতর থেকে দেখে দুরু-দুরু বক্ষে। মালেক কাছে এলে বলে 'ওই তর নাম কি ? ফ্যাল ফ্যাল করে শিশু মলি চেয়ে থাকে। ওকে সাথে করে দোকানে নিয়ে লোবেন্চুশ কিনে দেয়।ভাবে ছেলেটির সাথে ভাব জমাতে হবে। যতই হোক তার নিজের রক্ত তো বইছে 'অর শইলে' ।
কিন্তু ইবলিশ তো অপেক্ষাতেই আছে কুমন্ত্রনা দেওয়ার জন্য। সামনা সামনি পড়ে গেল ছইল্ল্যা গুন্ডা ওরফে সেলিম গুন্ডার। বড় বড় চুল, সামনের দুটো দাঁত বাঁধানো। মারা-মারি করতে গিয়ে দাঁত দুটো হারিয়েছে। সে বলে কেডা রে ? কোন .. এর পোলা লয়া ঘুরস। কাসেম এর বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। কি তার পোলাডারে কয় জারজ। তার বউ রে কয় বেশ্শ্যা । শোধ লইতে হইব, হময় আহুক। তখনও  বুঝি তার পিতা মাতার সততা আর নিষ্ঠা তার রক্তে বইছিল।তার বুকের কোনে চাপা পড়ে থাকা পিতৃত্ব বোধ জাগরূক হয়েছে । মালেকের নিষ্পাপ চোখ দুটো তার মনে দোলা  দিচ্ছিল।এর আগে সে নিজেই কতবার তার জান পেহচান বন্ধুদের সামনে সোহাগী কে এমন কুত্সিত ভাষায় গাল দিয়েছে। সে মনকে বুঝ দেয় নিজের বউ কে সে যা খুশি তাই বলতে পারে তা 'অন্যে কইবো  ক্যান' ?এত্ত  বড়
সাবাস!
সেদিনও রাত করে বাড়ি ফিরে খেতে চাইল..গলার স্বরে যেন ঢিমে সুর।শাশুড়ী বউ চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে।নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে নীচু গলায় বলে পান দেও।ওরা দুজন অবাক।এ কোন অজানা ভাষায় বিশ্রমভ্বালাপ শুনছে। দুজনের চোখে অজস্র ধারায় নোনা স্রোতের ঢল নামে।শিশু মালেক নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় ঘুমিয়ে রইল।জীবনের এসব টানা-পোড়েন তখনও আঁচড় কাটেনি ওর গায়ে।

সকাল হলো । আজ সোহাগীর যেন সূর্যটাকে বড় বেশি সুন্দর লাগলো।হনুফার মনে হলো মুরগীগুলো যেন সেদিন দর্মা থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য কম উৎপাত করছে।আহ্..সুদিন কি আগতপ্রায়!সুখস্বপ্নে ওরা বিভোর।ঠিক তখনই মূর্তমান শনি ছইল্ল্যা গুন্ডা সাংগ পাংগ নিয়ে এসে ষাঁড়ের মত  চীৎকার করে।'ওই হারামজাদা কাইস্যা,গেলি কই,..পুত জলদি ল।কামে যাইতে হইব না?কাম যে কি! খোদাই জানে। কোথায় যে কার কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছে কে জানে!ধড়-মড় করে উঠে তাড়াতাড়ি সার্ট গায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেলো।সেই যাওয়াই  শেষ যাওয়া।আর কোনদিন সে ফিরে এল না। কথায় বলে সুখের চেেয়ে শান্তি ভাল,শান্তির চেয়ে স্বস্তি ভাল।।

সেদিন নতুন তিন সাগরেদ এসে জুটেছিলো ছইল্ল্যার সাথে। প্রমোদ,নকিব আর মতলুব। নতুন নাম লিখিয়েছে বুঝি বা দলে। প্রমোদ এর মাথায় বারান্দা দেওয়া কালো টুপি,পরিধানে কালো শার্ট,কালো জিন্স এর প্যান্ট। কুকর্ম করে অন্ধকারে উধাও হতে বড় সুবিধে। নকিবের দোহারা নোংরা চেহারায় এক গাল তদুপরি নোংরা দাড়ি। কুকর্ম করতে নাকি ওর জুড়ি নেই। আর মতলুব ছোটখাটো চেহারায় মনে হয় যেন নির্ভেজাল,নিপাট ছোট নিষ্পাপ মানুষ। বদের হাড্ডি। যত বদ কাজের কুপরিকল্পনা ওর 'মস্তিস্ক উদ্ভাবিত'।                                 
তা সুখ হারিয়ে শান্তি খোঁজার অভিপ্রায়ে হনুফা ঘরে সুন্দরী বউ এনেছিল। সুখ রইলো মরিচিকা হয়ে। কাসেম এর এক বেলার দুটো মিষ্টি কথায় ওরা একটু  স্বস্তির আলো ঝলকানি দেখতে পেয়েছিল। বহুদিন পর সুস্বপ্নে রাত ভোর হযেছিল সোহাগীর।হনুফাও অনেদিন পর সে রাতে হযেছিল কাসেমের মা -স্বপ্নে। সেই সুখ,শান্তি ,স্বস্তি কোনটাই এলো না হনুফা আর সোহাগীর  ঘরে  - ওসব অধরা হয়েই রইলো ওগুলো ওদের কাছে।

অজানা আশংকায় ওদের দিন কাটে।তিন চার দিনের মাথায় সেলিম ওরফে ছইল্ল্যা ওর সাংগ -পাংগ নিয়ে ওদের উঠোনে এসে আসন গাড়ে।
সেলিম বলে,খালা কাসেম কো ?বাবি কই, দেকতাছিনা যে। কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই,'বাবি,বাবি চা খাওয়ান তো,বলে কাসেম সোহাগীর শয়নকক্ষে হাজির হয় সেলিম।অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে সোহাগী আর হনুফার। সাহস করে হনুফা বলে, তোমারি তো জানার কতা,তোমার লগে ঘুরে-ফিরে, বার হইল তোমার লগে। নিমেষে সেলিমের চেহারা পাল্টে গেল। বদলে গেল গলার তরল স্বর। পরিবর্তে খসখসে গলায় বলে উঠলো, আইলাম চা খাইতে। আজ তিনদিন ধইরা হ্যারে দেখি না। দেহেন কুন বাজারে মাইয়া  লোক লইয়া পইড়া আছে। হালার চুরিত্রের দুষ আছিল। গরে  বউ থুইয়া আকাম-কুকাম কইরা বেড়াইত ।ওর সঙ্গীদের পরস্পরের মুখ চাওয়া -চাওয়ি হনুফার দৃষ্টি এড়ালো  না। সেদিনের মত ওরা দলে বলে নিষ্ক্রান্ত হলেও বাড়ির চারপাশে ওরা ঘুর-ঘুর করতে শুরু করলো।ঘন ঘন আসা যাওয়া শুরু হলো ছইল্ল্যা আর ওর  বন্ধুদের।এদিকে বাতাসে ভেসে আসছে গুজব ছইল্ল্যা আর তার দলবলের কাসেম কে খুন করে খালে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা।
দুই বেদনাদ্র অসহায় নারীর বুকের গভীরে নীল ক্ষত।এক মা যার জঠরে জন্ম নেয়া সন্তান মালেক বুকের বহমান ফল্গুধারায় তিলে তিলে বড় হলো।আর এক নারী যার যৌবন ও  হৃদয় লুন্ঠিত  হলো এই একই ব্যক্তি দ্বারা।কি বিচিত্র মানব জীবন।আজ তার জন্যই ওরা নিভৃতে চোখের জল ঝরায়।

চুপি সাড়ে কেউ একজন জানিয়ে গেল কাসেমের দূর্গতির খবর।আর ওদের এই ভিটে-জমিটুকুর দিকে নজরের কথাও জানা গেল। ছইল্ল্যার সোহাগীর প্রতি লালসার কথা তো কারো অজানা নয়।মালেকের প্রতিও ওদের নজর পড়েছে  শুধু ওরা আছে সুযোগের অপেক্ষায়। প্রধান পথের কাঁটা কাসেমেকে ওরা উপড়ে ফেলেছে।

আতংকিত হনুফা এবং সোহাগী এবার মালেকের নিরাপত্তায় মনোযোগী হয়।ততদিনে মালেক পাঁচ বৎসর পার করেছে।অবুছ শিশু।সোহাগীর বুক দুরু দুরু করে।এরপর হতে সোহাগী মালেককে নোংরা রাখা শুরু করে। সোহাগী নিজেও এলোমেলো নোংরা হয়ে সৌন্দর্য  চাপা দিয়ে লোকের কুনজর থেকে পরিত্রান খুঁজে।

 মালেক ক্রমশ বড় হচ্ছে।লাউ ডগার মত ধড় ধড় করে।কিন্তু সে যেন পোলোয় আগলে বড় করা গৃহস্থর মুরগী-ছানা।হাতে -পায়ে সে বেশ তাগড়া হয়ে উঠছে।ওর মা আর দাদীর তো বুক কাঁপে থরথর।কি অদ্ভূত পুরুষ মানুষ তাড়াতাড়ি বড় হচ্ছে এতে এতো আতংকিত হওয়ার কি ঘটল বয়স যে মাত্র বার হলো!

ছইল্ল্যা আবার একদিন এলো হনুফার ভিটেয় বলা বাহুল্য দলবল নিয়ে।এসেই হুন্কার তুলল চা খিলান খালা।দরজার চৌকাঠে বসা মালেক বলে ওঠে,আমাগো বাসায় চা খাইতে আইছেন,আমাগো তো সব গেছে।আমরা চা পামু কই? ভাতই পাই না।

নির্লজ্জ ছইল্ল্যা অতঃপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে বলে,খালা এইডা তোমার নাতি ?বড় ক্যাডর ক্যাডর করে তো।তা খালা তোমারে একডা কথা কইতাম আইছিলাম।আমার বাপ-মা থাকলে হেরাই কইত।

খালা গম্ভীর স্বরে বলে কও কি কইবা।হনুফা তার অভিঞ্গতা থেকে আঁচ করতে পেরেছে কথা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে।ছইল্ল্যা বলে আপনেগো কষ্ট আমি বুঝি।আপনার নাতি তো কয়াই ফালাইল ভাতের কষ্টের কথা। তা আপনারে তো কইতে শরমাই।আমি সোহাগীরে বিয়া করতে চাই।
কি কইলা,হনুফা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
খালা হুধা হুধাই চ্যেততাছেন।আগিলা বউরে লাথ্থি দিয়া বাইর কইরা দিমু।
মালেক উঠে দাঁড়িয়ে আকস্মিক ভাবে চীৎকার উঠে,বাইরান বাইরান কইতাছি।
হনুফা আর সোহাগীদুজনে দৌড়ে এসে মুখ চেপে ধরে মালেকের।পুলাপান মানুষ মাফ কইরা দেন যুগপৎ বলে ওঠে  তখন হনুফা আর সোহাগী।কিন্তু ধনুক ছেড়ে তীর যে তখন বেরিয়ে গেছে। ছইল্ল্যার চীৎকারে ছোট ভিটেটুকু থর থর করে কেঁপে ওঠে।আর সেইসাথে কেঁপে ওঠে হনুফা আর সোহাগীর কলিজা।বিস্ফারিত চোখে ওরা বারবার অনুনয়-বিনয় করতে থাকে।সেলিম গুন্ডা শপথ করে, 'খুব বাইড়্যা গেছস বাপের লাহান।খাড়া ইবার(?) তর মুন্ডু ফালামু,আমি যদি হইয়া থাকি বাপের ব্যাটা ছেলিম'।

আতংক গ্রাস করে মালেকের মা ও দাদীকে।দুজনের নজরবন্দী মালেক অস্থিরতায় ভোগে।ইস্কুল যাওয়া আসায় দাদী সংগী।মালেক হাঁপিয়ে ওঠে।সহ-পড়ুয়াদের হাসির খোরাক হতে আপত্তি!মালেকের দাদী পরে বোঝায়,হুনছস তো আজরাইল কি কয়্যা গেল্।আইচ্ছা ঠিক আছে আমরা
এহন থন হোজাহুজি না গিয়া যামু ওই  আকন(আকন্দ) বনের ভিতর দিয়া।
মালেক বলে,'ঐ দাদী উয়ানে তো মাইনষে আগে'।দাদী প্রতি উত্তর করে আগবই তো।আগব না আগা পাইলে।ল মেলা কর্ দিক করিস না।ছুটি অইলে ওই জংগুলে আমি আবডাল অইয়া থাকমু।তোরে হুক্করি দিমু তুই আমারে দেখবি। হের পর দাদী -নাতি একলগে আয়া পড়মু।

এদিকে মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দে আক্রান্ত সোহাগী।অনবরত টানাপোড়েনের নিষ্ঠুর খেলায় সে শ্রান্ত।বিধ্বস্ত তার দেহ-মন।চিন্তাচ্ছন্ন মন তাকে প্রশ্ন করে কিভাবে রক্ষা করবে তোমার স্নেহের ধন কলিজার টুকরা।ছাচরা মাছওলি জরিনা ইংগিত দিয়ে গেল হনুফার অগোচরে,'আমার মুনে লয় ছইলল্যার পসতাবে রাজি অয়নই বালা।পুলাও বাঁচপ ,তুমার জায়গা জিরেতও বাঁচপ'।মালেককে সে হারাতে চায়না কোনো ভাবেই। আবার তার ঘৃণা-সেলিমকে দেখলেই তার 'উটকানি আহে'।আর মালেকের বাপের প্রতি তার  একপেশে ক্ষীন 'মহব্বত' তো এখনও বিদ্যমান।আর মালেক তার সাত রাজার ধন মালেক! এভাবে মালেককে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে কি তার চক্ষুশূল হবে না?মনে মনে বলে,'জরি তুমার কতা চিন্তা করসি,তয় উয়া তো অয় না। একডাই পুলা আমার! কইলজার টুকরা।   

হনুফা আর সোহাগীর এই সবসময় আগলে রাখা, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকা প্রভাবিত করে মালেককেও।মালেক যে এখন বই পড়ে।সামাদ স্যার কত ভালো ভালো কথা শেখান।বলেন নির্ভিক হতে, সাহসের সাথ সব মোকাবেলা করতে।কিন্তু ছইলল্যার গণগণে আগুন চোখ আর ক্রুদ্ধ মূর্তি ওকে একবারে মুরগী ছানার মত মা-দাদীর ডানার তলায় লুকিয়ে ফেলে।খুব ভয় খায় যখন অনেক দূর থেকেও ছইল্ল্যাকে দেখে।ছুটে এসে  ঘরের কোণে লুকিয়ে পড়ে।আর সব সব ছেলেরা কেমন মাঠে বল খেলে।ও তো যেতে পারে না,পায়ে যে শিকল বাঁধা-মা আর দাদীর আকুির শিকল।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় পড়া শেষে চৌদ্দ বছরের কিশোর মালেক তন্ময় হয়ে পড়ছিলো রবি ঠাকুরের 'বীরপুরুষ'কবিতাটি।ঘুম পেয়ে গেলে বিছানায় মা আর দাদীর মাঝখানে শুয়ে পড়ে।মা আর দাদীর পাশে থাকে সবসময় একটা করে দা' আর কাঠের শক্ত পিঁড়ি।আত্মরক্ষার জন্যে।শুতে যাওয়ার সময় প্রতিদিন মালেেকের ভয় করে।সেদিনও গেল ঘুমুতে সে মনে ভয় নিয়ে।

সবাই ঘুমুচ্ছে ।খুট খুট একটা আওয়াজ হচ্ছে।ঘুমের ঘোরে মালেক দেখল একটা ভীষণ-দর্শন জন্তু ঘরে ঢুকছে।মূহুর্তের মধ্যে সে দাও নিয়ে ছুটে গিয়ে এক কোপে মাথা ফেলে দিলো জন্তুটার।আঃ !এক মূমুর্ষ চীৎকারে তার সম্বিৎ ফিরে এলো। সে খোলা দরজা দিয়ে ছিটকে ঘরের দাওয়ায় এসে পড়ল।দু টো গুন্ডা তেড়ে এসেছিলো তার দিকে ।কিন্তুু তার রণচন্ডী মূর্তি দেখে ভয়ে পালাল।ঘরে পড়ে আছে ছইল্ল্যার মাথাকাটা নিথর দেহ।

মালেকের আর ভয় করছে না।

সকাল হলো,লোকে লোকারণ্য হয়েছে তাদের ভিটে।পুলিশ এসে নিয়ে গেল মালেককে।সবার চোখে মালেক-চৌদ্দ বছরের মালেক আজ বীরপুরুষ!!

সমস্ত বিবরণ শুনে আর বয়স বিবেচনায় বিঞ্গ আদালত মালেককে তিন বছরের জন্য কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠালো।

সংশোধণী কেন্দ্রে মালেকেকে আর ত্রাস তাড়া করছে না। আজ সে মুক্ত।