Wednesday 1 June 2016

ত্রাস

অনবরত একটা ত্রাস মালেককে  তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সে জানেনা কবে  সে মুক্তি পাবে এর হাত থেকে।মুক্তি তার চাই -ই  চাই।কিন্তু সে জানে না সে মু্ক্তি কি ভাবে আসবে। কখন আসবে।কে সে নমস্য ব্যক্তি যে তাকে মুক্তি দেবে।কিন্তু  মুক্তি যে তার চাওয়া।এভাবে কেঁচোর মত বেঁঢে থাকা।সে দুমুঠো কম খেয়ে হলেও নিষ্কৃতি চায়।দুর্যোগ,ভয় নিরাশা তাকে এই বয়সেই অনেক
ভাবতে শিখিয়েছে।

 শৈশবএর কটি বছর কেটেছিলো নিশ্চিন্তে।
 ফর্সা সোনালী  পূর্নিমার চাঁদের মত  মুখ ছিল মায়ের। ঝকঝকে ফর্সা নীল কাঁচের চুড়ি  পরা দুটি হাত পরম মমতায় ওকে স্নান করিয়ে দিত।অবশেষে ভেজা কাপড়ের উপরে একখানা গামছা জড়িয়ে ওর হাত ধরত।
এক পাঁজা মাজা বাসন কোসন থাকত আর এক কাঁখে।কোমরে কালো ঘুনসির সাথে বাঁধা থাকত একটি ঘুঙুর । শুধু কি ঘুঙুর, ঘুনসির সাথে আরো বাঁধা ছিল একটা ধপধপে সাদা কড়ি আর একটা ফুটো পিতলের পয়সা।ওটি নাকি পাকিস্তানি আমলের' হয়সা'।  ওর দাদী বলত।এ দুটি ছিল অমঙ্গল আর অশরীরী অশুভ আত্মা থেকে রক্ষার রক্ষাকবজ। ন্যাংটো  দিগম্বর সে এগুতো  মাযের  সাথে সাথে। হাঁটার  তালে তালে কোমরে  কালো ঘুনসির সাথে বাঁধা  ঘুঙুরটি বাজত টুং টুং ..টুং টুং। পাছে খেলতে খেলতে সে দুরে কোথাও চলে যায়..মা আর দাদী তাই সাবধানতায় সবসময় তার ঘুনসির ঘুঙুরের আওয়াজ এর দিকে কান পেতে থাকত।। 


তার বাবার কোনো স্মৃতি তার কাছে নেই। ভালবাসা স্নেহ আলিঙ্গন কিছু স্মরণ পড়ে না তার। শুধু ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে কেউ একজন দোকানে নিয়ে একদিন একটা লাবেন্চুস কিনে দিয়েছিল। মা মাঝে মাঝে থম মেরে বসে থাকত। ওর  তখন বড় খারাপ লাগত। সেদিন গুলোয়  দাদী রান্না বাড়া সব করত। আর গজ গজ করত,পুংটা পুলাডা মরেও না। কারা সব লোকজন আসত। কেমন যেন লোকগুলো। দাদির প্রায় পড় পড়  ঘরটায় যেয়ে হই-হল্লা করত। দাদী ঘরের ভিতর গুমসাতো,মর মর  অলাউডা  হইয়া মর্। মা ঘরের কোনে জড়-সড়  হয়ে বসে  থাকত। 'হারামজাদা মরেও না।মরলে হিণ্ণি দিমু মাজারে'।
মা তখনও ওকে ঘসে মেজে চকচকে করে রাখত।
বড় হবার পর,ওর বাবা মারা যাবার পর ওর মা ওকে গল্প বলত। তার জীবনের গল্প। গল্প বলার সময় মা যেন কোথায়  হারিয়ে যেত। শুনেছিল ভাগ্যান্বেষণে দাদা তার যৌবনকালে সরিষা বাড়ি থেকে ময়মনসিং এর  জামালপুরে আসে স্ত্রীর হাত ধরে। জীবিকায় ছিল একজন দর্জি। সবাই ডাকত 'হ্যালাল' খলিফা বলে। হেলাল এর স্ত্রী হনুফা ছিল বুদ্ধিমতি আর সহনশীল। সংসারে উন্নতি হতে থাকলো,ওরা দুজন কিছু জমি জিরেত ও করলো। সংসারে এলো স্বচ্ছলতা আর সুখ।ছোট সংসার তিনজনের-  হেলাল,হনুফা আর ওদের একমাত্র ছেলে কাসেম। কিন্তু বিধি বাম।

 খলিফাও মরলো সংসারে ও ভাঙ্গন ধরল। আস্তে আস্তে হনুফার ছেলে বিগড়ে যেতে থাকলো।পাড়ার বদ ছেলে পিলেদের  সঙ্গে মিশে এ হেন কু কর্ম নাই  যাতে সে  লিপ্ত হলো না।রাগ,বকা ঝকা কোনো কিছু করেই ছেলে কাসেম কে ফিরতে পারল না হনুফা।কাসেম এর উত্পাত ক্রমশ বেড়েই চলল। আমারে গাং এ ভাসাইয়া  দিয়া ব্যাডা মাটির তলে হান্দাইছে,গতপ্রান স্বামীর ওপর অভিমান করে হনুফা স্বগোত্উক্তি করত।উপায়ান্তর না পেয়ে চিরাচরিত বাঙালি মায়ের পথই অনুসরণ করবে বলে মনস্থির করলো হনুফা।
ভাবলো নিশ্চয়ই সুন্দরী বউ ঘরে আসলে কাসেম এর মন গৃহমুখী হবে..কিন্তু ততদিনে কাসেম হয়ে গেছে 'কাসু গুন্ডা' ।বিকৃত করে কেউ কেউ বলে 'কাইসসা গুন্ডা'।অবশেষে কাইসসা গুন্ডার মা সুন্দরী  মেয়ের খোঁজ পেলেন।  ইসলামপুরে হত দরিদ্র  বাপ মাযের ঘর আলো  করা রূপসী মেয়ে। হনুফা আর দেরী না করে তড়ি ঘড়ি বউ নিয়ে এলেন ঘরে। মেয়ে আবার নাকি ইস্কুলেও পড়েছে পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত।
বিয়ের সময় মা লক্ষ্য করলেন ছেলের চোখে মুগ্ধতা। মুখ টিপে হাসলো হনুফা।এইবার ছেলে জব্দ। সারাদিন বৌএর আঁচল ধরে ধরেই ঘুরবে। তাতে আপত্তি কি!এটাই তো তার চাওয়া। সোনার ছেলে কাসেম ঘরমুখী হবে। ভাগ্যদেবী তখন মুচকি মুচকি হাসছে।  মাত্র বোধহয় চার কি পাঁচ দিন। এর ভিতরেই কাসেমের চোখের ঘোর  কেটে গেল। বেরিয়ে গেল বন্ধুদের সাথে। ফিরল পাঁড় মাতাল হয়ে। খিস্তি-খেউর করে সোহাগী আর হনুফার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ল। কাসেমের বর্বর দাবির মুখে ভেসে গেল জমি-জিরেত। সর্বকালের মত লোভী স্বার্থাণ্বেষি মহল তো সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো এবার তারা এর সদ্বব্যবহার করতে দ্বিধা করল না।

  
সেই শুরু হলো তা আর থামল না কোনদিন যতদিন না..
কাসেম পোশাক চরিত্র দুইই পাল্টে ফেলল ।তার পরনে এখন, চকরা -বকরা রং-চং এ সার্ট। গলায় লাল সিল্কের রুমাল। ডান  হাতের  আঙ্গুলে রুপো  বাঁধানো সবুজ পাথরের আংটি । সবাই জানে ওই হাতের এক ঘুষিতে কাসেম গাল মুখ ফাটিয়ে দিতে পারে। কোমরে গুঁজে রাখে দুমুখো স্প্রিং এর ছুরি । গায়ে ভুরভুর করে সস্তা সুগন্ধি।ঘরে ঢুকেই খিস্তি শুরু করে দেয়,
ওই ফহিন্নির মাইয়া  ফহিন্নি জলদি বাত দে। ওই মা তুই মরছস নি। ট্যাকা বাইর কর ।জলদি কর ক'লম। ঘরে ক'লম আগুন লাগাইয়া দিমু। ভয়ে সুড় সুড় করে টাকা বের করে দিত হনুফা। আর পুত্রের মৃত্যু কামনা করত। ততদিনে সোহাগীর ঔরসে মালেকের জন্ম হয়েছে।প্রথম কদিনের সোহাগির সাথে রাত্রি যাপনে মালেক বীজ বপন করেছে। মালেকের জন্মের পর বলে, কই থাইক্কা পেট বাজাইয়া বাচ্চা পয়দা করলি। হালি নডি। মা যে কই থেইকা ধইরা আনছে বেশ্যাটারে ।
সোহাগী আর হনুফা বাচ্চাটাকে লুকিয়ে রাখে। কাসেম এর সামনা-সামনি হতে দেয় না। তবুও কবে যেন একদিন কাসেমের সামনে পড়ে  গেল মালেক। 
এত সুন্দর ! এত সুন্দর শিশু! এটি  নাকি তার সন্তান। বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো।তখনতার বছর দেড়েকের মত বয়স।
এত সুন্দর ! এত সুন্দর ফেরেশ্তার মত !ফেরেশস্তা দেখতে কেমন কাসু জানে না।তবে মনের গহীন কোণে তো এমন ছবিই আঁকা। এটি তার সন্তান! বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো। আরো একদিন কাসু গুন্ডার সামনা সামনি পড়ে গেল মলি ওরফে মালেক ।সোহাগী আদর করে এ নামেই তাকে ডাকে। কাসেম ডাকে কাছে। হনুফা আর সোহাগী ঘরের ভিতর থেকে দেখে দুরু-দুরু বক্ষে। মালেক কাছে এলে বলে 'ওই তর নাম কি ? ফ্যাল ফ্যাল করে শিশু মলি চেয়ে থাকে। ওকে সাথে করে দোকানে নিয়ে লোবেন্চুশ কিনে দেয়।ভাবে ছেলেটির সাথে ভাব জমাতে হবে। যতই হোক তার নিজের রক্ত তো বইছে 'অর শইলে' ।
কিন্তু ইবলিশ তো অপেক্ষাতেই আছে কুমন্ত্রনা দেওয়ার জন্য। সামনা সামনি পড়ে গেল ছইল্ল্যা গুন্ডা ওরফে সেলিম গুন্ডার। বড় বড় চুল, সামনের দুটো দাঁত বাঁধানো। মারা-মারি করতে গিয়ে দাঁত দুটো হারিয়েছে। সে বলে কেডা রে ? কোন .. এর পোলা লয়া ঘুরস। কাসেম এর বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। কি তার পোলাডারে কয় জারজ। তার বউ রে কয় বেশ্শ্যা । শোধ লইতে হইব, হময় আহুক। তখনও  বুঝি তার পিতা মাতার সততা আর নিষ্ঠা তার রক্তে বইছিল।তার বুকের কোনে চাপা পড়ে থাকা পিতৃত্ব বোধ জাগরূক হয়েছে । মালেকের নিষ্পাপ চোখ দুটো তার মনে দোলা  দিচ্ছিল।এর আগে সে নিজেই কতবার তার জান পেহচান বন্ধুদের সামনে সোহাগী কে এমন কুত্সিত ভাষায় গাল দিয়েছে। সে মনকে বুঝ দেয় নিজের বউ কে সে যা খুশি তাই বলতে পারে তা 'অন্যে কইবো  ক্যান' ?এত্ত  বড়
সাবাস!
সেদিনও রাত করে বাড়ি ফিরে খেতে চাইল..গলার স্বরে যেন ঢিমে সুর।শাশুড়ী বউ চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে।নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে নীচু গলায় বলে পান দেও।ওরা দুজন অবাক।এ কোন অজানা ভাষায় বিশ্রমভ্বালাপ শুনছে। দুজনের চোখে অজস্র ধারায় নোনা স্রোতের ঢল নামে।শিশু মালেক নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় ঘুমিয়ে রইল।জীবনের এসব টানা-পোড়েন তখনও আঁচড় কাটেনি ওর গায়ে।

সকাল হলো । আজ সোহাগীর যেন সূর্যটাকে বড় বেশি সুন্দর লাগলো।হনুফার মনে হলো মুরগীগুলো যেন সেদিন দর্মা থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য কম উৎপাত করছে।আহ্..সুদিন কি আগতপ্রায়!সুখস্বপ্নে ওরা বিভোর।ঠিক তখনই মূর্তমান শনি ছইল্ল্যা গুন্ডা সাংগ পাংগ নিয়ে এসে ষাঁড়ের মত  চীৎকার করে।'ওই হারামজাদা কাইস্যা,গেলি কই,..পুত জলদি ল।কামে যাইতে হইব না?কাম যে কি! খোদাই জানে। কোথায় যে কার কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছে কে জানে!ধড়-মড় করে উঠে তাড়াতাড়ি সার্ট গায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেলো।সেই যাওয়াই  শেষ যাওয়া।আর কোনদিন সে ফিরে এল না। কথায় বলে সুখের চেেয়ে শান্তি ভাল,শান্তির চেয়ে স্বস্তি ভাল।।

সেদিন নতুন তিন সাগরেদ এসে জুটেছিলো ছইল্ল্যার সাথে। প্রমোদ,নকিব আর মতলুব। নতুন নাম লিখিয়েছে বুঝি বা দলে। প্রমোদ এর মাথায় বারান্দা দেওয়া কালো টুপি,পরিধানে কালো শার্ট,কালো জিন্স এর প্যান্ট। কুকর্ম করে অন্ধকারে উধাও হতে বড় সুবিধে। নকিবের দোহারা নোংরা চেহারায় এক গাল তদুপরি নোংরা দাড়ি। কুকর্ম করতে নাকি ওর জুড়ি নেই। আর মতলুব ছোটখাটো চেহারায় মনে হয় যেন নির্ভেজাল,নিপাট ছোট নিষ্পাপ মানুষ। বদের হাড্ডি। যত বদ কাজের কুপরিকল্পনা ওর 'মস্তিস্ক উদ্ভাবিত'।                                 
তা সুখ হারিয়ে শান্তি খোঁজার অভিপ্রায়ে হনুফা ঘরে সুন্দরী বউ এনেছিল। সুখ রইলো মরিচিকা হয়ে। কাসেম এর এক বেলার দুটো মিষ্টি কথায় ওরা একটু  স্বস্তির আলো ঝলকানি দেখতে পেয়েছিল। বহুদিন পর সুস্বপ্নে রাত ভোর হযেছিল সোহাগীর।হনুফাও অনেদিন পর সে রাতে হযেছিল কাসেমের মা -স্বপ্নে। সেই সুখ,শান্তি ,স্বস্তি কোনটাই এলো না হনুফা আর সোহাগীর  ঘরে  - ওসব অধরা হয়েই রইলো ওগুলো ওদের কাছে।

অজানা আশংকায় ওদের দিন কাটে।তিন চার দিনের মাথায় সেলিম ওরফে ছইল্ল্যা ওর সাংগ -পাংগ নিয়ে ওদের উঠোনে এসে আসন গাড়ে।
সেলিম বলে,খালা কাসেম কো ?বাবি কই, দেকতাছিনা যে। কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই,'বাবি,বাবি চা খাওয়ান তো,বলে কাসেম সোহাগীর শয়নকক্ষে হাজির হয় সেলিম।অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে সোহাগী আর হনুফার। সাহস করে হনুফা বলে, তোমারি তো জানার কতা,তোমার লগে ঘুরে-ফিরে, বার হইল তোমার লগে। নিমেষে সেলিমের চেহারা পাল্টে গেল। বদলে গেল গলার তরল স্বর। পরিবর্তে খসখসে গলায় বলে উঠলো, আইলাম চা খাইতে। আজ তিনদিন ধইরা হ্যারে দেখি না। দেহেন কুন বাজারে মাইয়া  লোক লইয়া পইড়া আছে। হালার চুরিত্রের দুষ আছিল। গরে  বউ থুইয়া আকাম-কুকাম কইরা বেড়াইত ।ওর সঙ্গীদের পরস্পরের মুখ চাওয়া -চাওয়ি হনুফার দৃষ্টি এড়ালো  না। সেদিনের মত ওরা দলে বলে নিষ্ক্রান্ত হলেও বাড়ির চারপাশে ওরা ঘুর-ঘুর করতে শুরু করলো।ঘন ঘন আসা যাওয়া শুরু হলো ছইল্ল্যা আর ওর  বন্ধুদের।এদিকে বাতাসে ভেসে আসছে গুজব ছইল্ল্যা আর তার দলবলের কাসেম কে খুন করে খালে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা।
দুই বেদনাদ্র অসহায় নারীর বুকের গভীরে নীল ক্ষত।এক মা যার জঠরে জন্ম নেয়া সন্তান মালেক বুকের বহমান ফল্গুধারায় তিলে তিলে বড় হলো।আর এক নারী যার যৌবন ও  হৃদয় লুন্ঠিত  হলো এই একই ব্যক্তি দ্বারা।কি বিচিত্র মানব জীবন।আজ তার জন্যই ওরা নিভৃতে চোখের জল ঝরায়।

চুপি সাড়ে কেউ একজন জানিয়ে গেল কাসেমের দূর্গতির খবর।আর ওদের এই ভিটে-জমিটুকুর দিকে নজরের কথাও জানা গেল। ছইল্ল্যার সোহাগীর প্রতি লালসার কথা তো কারো অজানা নয়।মালেকের প্রতিও ওদের নজর পড়েছে  শুধু ওরা আছে সুযোগের অপেক্ষায়। প্রধান পথের কাঁটা কাসেমেকে ওরা উপড়ে ফেলেছে।

আতংকিত হনুফা এবং সোহাগী এবার মালেকের নিরাপত্তায় মনোযোগী হয়।ততদিনে মালেক পাঁচ বৎসর পার করেছে।অবুছ শিশু।সোহাগীর বুক দুরু দুরু করে।এরপর হতে সোহাগী মালেককে নোংরা রাখা শুরু করে। সোহাগী নিজেও এলোমেলো নোংরা হয়ে সৌন্দর্য  চাপা দিয়ে লোকের কুনজর থেকে পরিত্রান খুঁজে।

 মালেক ক্রমশ বড় হচ্ছে।লাউ ডগার মত ধড় ধড় করে।কিন্তু সে যেন পোলোয় আগলে বড় করা গৃহস্থর মুরগী-ছানা।হাতে -পায়ে সে বেশ তাগড়া হয়ে উঠছে।ওর মা আর দাদীর তো বুক কাঁপে থরথর।কি অদ্ভূত পুরুষ মানুষ তাড়াতাড়ি বড় হচ্ছে এতে এতো আতংকিত হওয়ার কি ঘটল বয়স যে মাত্র বার হলো!

ছইল্ল্যা আবার একদিন এলো হনুফার ভিটেয় বলা বাহুল্য দলবল নিয়ে।এসেই হুন্কার তুলল চা খিলান খালা।দরজার চৌকাঠে বসা মালেক বলে ওঠে,আমাগো বাসায় চা খাইতে আইছেন,আমাগো তো সব গেছে।আমরা চা পামু কই? ভাতই পাই না।

নির্লজ্জ ছইল্ল্যা অতঃপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে বলে,খালা এইডা তোমার নাতি ?বড় ক্যাডর ক্যাডর করে তো।তা খালা তোমারে একডা কথা কইতাম আইছিলাম।আমার বাপ-মা থাকলে হেরাই কইত।

খালা গম্ভীর স্বরে বলে কও কি কইবা।হনুফা তার অভিঞ্গতা থেকে আঁচ করতে পেরেছে কথা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে।ছইল্ল্যা বলে আপনেগো কষ্ট আমি বুঝি।আপনার নাতি তো কয়াই ফালাইল ভাতের কষ্টের কথা। তা আপনারে তো কইতে শরমাই।আমি সোহাগীরে বিয়া করতে চাই।
কি কইলা,হনুফা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
খালা হুধা হুধাই চ্যেততাছেন।আগিলা বউরে লাথ্থি দিয়া বাইর কইরা দিমু।
মালেক উঠে দাঁড়িয়ে আকস্মিক ভাবে চীৎকার উঠে,বাইরান বাইরান কইতাছি।
হনুফা আর সোহাগীদুজনে দৌড়ে এসে মুখ চেপে ধরে মালেকের।পুলাপান মানুষ মাফ কইরা দেন যুগপৎ বলে ওঠে  তখন হনুফা আর সোহাগী।কিন্তু ধনুক ছেড়ে তীর যে তখন বেরিয়ে গেছে। ছইল্ল্যার চীৎকারে ছোট ভিটেটুকু থর থর করে কেঁপে ওঠে।আর সেইসাথে কেঁপে ওঠে হনুফা আর সোহাগীর কলিজা।বিস্ফারিত চোখে ওরা বারবার অনুনয়-বিনয় করতে থাকে।সেলিম গুন্ডা শপথ করে, 'খুব বাইড়্যা গেছস বাপের লাহান।খাড়া ইবার(?) তর মুন্ডু ফালামু,আমি যদি হইয়া থাকি বাপের ব্যাটা ছেলিম'।

আতংক গ্রাস করে মালেকের মা ও দাদীকে।দুজনের নজরবন্দী মালেক অস্থিরতায় ভোগে।ইস্কুল যাওয়া আসায় দাদী সংগী।মালেক হাঁপিয়ে ওঠে।সহ-পড়ুয়াদের হাসির খোরাক হতে আপত্তি!মালেকের দাদী পরে বোঝায়,হুনছস তো আজরাইল কি কয়্যা গেল্।আইচ্ছা ঠিক আছে আমরা
এহন থন হোজাহুজি না গিয়া যামু ওই  আকন(আকন্দ) বনের ভিতর দিয়া।
মালেক বলে,'ঐ দাদী উয়ানে তো মাইনষে আগে'।দাদী প্রতি উত্তর করে আগবই তো।আগব না আগা পাইলে।ল মেলা কর্ দিক করিস না।ছুটি অইলে ওই জংগুলে আমি আবডাল অইয়া থাকমু।তোরে হুক্করি দিমু তুই আমারে দেখবি। হের পর দাদী -নাতি একলগে আয়া পড়মু।

এদিকে মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দে আক্রান্ত সোহাগী।অনবরত টানাপোড়েনের নিষ্ঠুর খেলায় সে শ্রান্ত।বিধ্বস্ত তার দেহ-মন।চিন্তাচ্ছন্ন মন তাকে প্রশ্ন করে কিভাবে রক্ষা করবে তোমার স্নেহের ধন কলিজার টুকরা।ছাচরা মাছওলি জরিনা ইংগিত দিয়ে গেল হনুফার অগোচরে,'আমার মুনে লয় ছইলল্যার পসতাবে রাজি অয়নই বালা।পুলাও বাঁচপ ,তুমার জায়গা জিরেতও বাঁচপ'।মালেককে সে হারাতে চায়না কোনো ভাবেই। আবার তার ঘৃণা-সেলিমকে দেখলেই তার 'উটকানি আহে'।আর মালেকের বাপের প্রতি তার  একপেশে ক্ষীন 'মহব্বত' তো এখনও বিদ্যমান।আর মালেক তার সাত রাজার ধন মালেক! এভাবে মালেককে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে কি তার চক্ষুশূল হবে না?মনে মনে বলে,'জরি তুমার কতা চিন্তা করসি,তয় উয়া তো অয় না। একডাই পুলা আমার! কইলজার টুকরা।   

হনুফা আর সোহাগীর এই সবসময় আগলে রাখা, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকা প্রভাবিত করে মালেককেও।মালেক যে এখন বই পড়ে।সামাদ স্যার কত ভালো ভালো কথা শেখান।বলেন নির্ভিক হতে, সাহসের সাথ সব মোকাবেলা করতে।কিন্তু ছইলল্যার গণগণে আগুন চোখ আর ক্রুদ্ধ মূর্তি ওকে একবারে মুরগী ছানার মত মা-দাদীর ডানার তলায় লুকিয়ে ফেলে।খুব ভয় খায় যখন অনেক দূর থেকেও ছইল্ল্যাকে দেখে।ছুটে এসে  ঘরের কোণে লুকিয়ে পড়ে।আর সব সব ছেলেরা কেমন মাঠে বল খেলে।ও তো যেতে পারে না,পায়ে যে শিকল বাঁধা-মা আর দাদীর আকুির শিকল।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় পড়া শেষে চৌদ্দ বছরের কিশোর মালেক তন্ময় হয়ে পড়ছিলো রবি ঠাকুরের 'বীরপুরুষ'কবিতাটি।ঘুম পেয়ে গেলে বিছানায় মা আর দাদীর মাঝখানে শুয়ে পড়ে।মা আর দাদীর পাশে থাকে সবসময় একটা করে দা' আর কাঠের শক্ত পিঁড়ি।আত্মরক্ষার জন্যে।শুতে যাওয়ার সময় প্রতিদিন মালেেকের ভয় করে।সেদিনও গেল ঘুমুতে সে মনে ভয় নিয়ে।

সবাই ঘুমুচ্ছে ।খুট খুট একটা আওয়াজ হচ্ছে।ঘুমের ঘোরে মালেক দেখল একটা ভীষণ-দর্শন জন্তু ঘরে ঢুকছে।মূহুর্তের মধ্যে সে দাও নিয়ে ছুটে গিয়ে এক কোপে মাথা ফেলে দিলো জন্তুটার।আঃ !এক মূমুর্ষ চীৎকারে তার সম্বিৎ ফিরে এলো। সে খোলা দরজা দিয়ে ছিটকে ঘরের দাওয়ায় এসে পড়ল।দু টো গুন্ডা তেড়ে এসেছিলো তার দিকে ।কিন্তুু তার রণচন্ডী মূর্তি দেখে ভয়ে পালাল।ঘরে পড়ে আছে ছইল্ল্যার মাথাকাটা নিথর দেহ।

মালেকের আর ভয় করছে না।

সকাল হলো,লোকে লোকারণ্য হয়েছে তাদের ভিটে।পুলিশ এসে নিয়ে গেল মালেককে।সবার চোখে মালেক-চৌদ্দ বছরের মালেক আজ বীরপুরুষ!!

সমস্ত বিবরণ শুনে আর বয়স বিবেচনায় বিঞ্গ আদালত মালেককে তিন বছরের জন্য কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠালো।

সংশোধণী কেন্দ্রে মালেকেকে আর ত্রাস তাড়া করছে না। আজ সে মুক্ত।


No comments:

Post a Comment