Saturday 25 June 2016

ভোঁদড় ও একজন শশধর

শৈলবালা খুব ভোরে পূব গগনে সূর্য  উঁকি দেওয়ার আগেই গোলাপি অরুণিমা গায়ে মেখে ভোঁদড় (ধাইরা)গুলো নিয়ে পশ্চিম দিকের ঝোপালো ঢিবিগুলোতে গেছে।ভোরের আবছা আলোয় ওখানে পাওয়া যায় বেশ কিছু কাঁকড়া আর পোকামাকড়--ধাইরার খাদ্য। ভোঁদড়(ধাইরা)গুলোকে নিজেরা না খেয়ে হলেও খাওয়াতে হয়।প্রাণ ভোমরা ভোঁদড়গুলো যে ওদের জীবিকা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার।

ওর স্বামী শশধর বিশ্বাস আজ ক'দিন ধরে বাড়ীতে নেই।বাড়ী শব্দটা মনে,নাকি মাথায় এলে ওর হাসি পায়।এটাও একটা বাড়ী!!বর্ষায় চাল দিয়ে জল পড়ে।পৌষ-মাঘে উত্তুরে ঠান্ডা কনকনে হাওয়া একেবারে হাড়ে কাঁপুনি  ধরিয়ে দেয়।তবে ঘরের চালের ফুটোর কারণে কোজাগরী পূর্ণিমার আলো  ভারী মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে পর্ণ কুটিরে।মনে পড়ে  আশ্বিণে এ বাড়ীতে প্রথম রাতে শশধর ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,বউ চাঁদের আলোয় তোমারে যে কি সুন্দর লাগতেছে।ও মনে মনে না হেসে পারেনি।ওর বাবার ঘর তো দৈন্যতায় এরকম দাঁত ব্যাদান করা হাসি হাসে না।

ভোঁদড়ের সাহায্যে মাছ শিকার ওদের মত অনেক মালো সম্প্রদায়ের আদি পেশা। কয়েক শতাব্দী ধরে ওরা এ পেশার সাথে যুক্ত।শৈলবালার বাবারা জাতে কৈবর্ত। তারা যেমন মাছ ধরত জাল ফেলে আবার যুগপৎ ভাবে জাল ফেলে আর ভোঁদড়ের সহায়তায় তেমনি আবার মহাজনের জমিতেও চাষ-বাসের কাজ-কর্মে নিযুক্তি পেত।শশধর আর ওর বাবাও যে কখনও জমি জিরেতে কাজ করেনি তা নয়।পূর্বে মালো আর কৈবর্তর ভিতর বিয়ের সন্মন্ধ ছিলো অসম্ভব।আজকাল সামাজিক নিয়ম নীতিগুলোয় অনেকটাই শিথিলতা এসেছে।শৈলবালার ছোটবোন গিরিবালারও তো পালটি ঘরে বিয়ে হয়নি।

ভোঁদড়গুলো ততক্ষনে ওদের  ধারাল নখরযুক্ত হাঁসের পায়ের পাতার মত পা দিয়ে হাঁচড় পাঁচড় করে মাটি খুঁড়ে উচ্চিংড়ে বার করে উদরপূর্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।তিন চার কেজি ওজনের হাত খানেক লম্বা ভোঁদড় যখন শিকার ধরার জন্য ছুটাছুটি করে  শৈলবালা তখন রীতিমত হিমসিম খায় ওদের সামলাতে।ঘর্মাক্ত শরীরে ও ভোঁদড়গুলোর গলায় বাঁধা রশিটা টেনে ধরে রাখে।

এতক্ষন শৈলবালা খেয়াল করে নি পশ্চিমের বাঁশ ঝাড়টার গোড়ায় নিকারি সামসুর লম্পট ছেলেটা গলায় লাল একটা মাফলার জড়িয়ে ওর দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।চিন্তার জাল ছিঁড়ে শূণ্যে দৃষ্টি রেখে শৈলবালা স্বগতোক্তি করে,আঃ মরণ আমার!ঝাঁটামারি পোড়ামুখে।নিকারি সামসু নিপাট ভালো মানুষ।শশধরের কাছ থেকে সস্তায় মাছ কিনে নেয় বটে,কিন্তু আর সব ভালো।বিপদে আপদে সুদবিহীন টাকা কর্জ দেয়। বাগানের কলাটা,মূলোটা দেয় কাকিমা মাঝে মধ্যে বিনিপয়সায়।আর এদিকে সামসু কাকার হতচ্ছাড়া ব্যাটা হাড়ে মজ্জায়একটা শয়তান।

শশধর গেছে দলের সাথে সুন্দর বনের গহীন জংগলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাটির চিত্রা নদীতে ভোঁদড়বিহীন মাছ ধরতে । সে এক অন্য পদ্ধতি।পাক্কা দশদিনের ধাক্কা আসা যাওয়ায়।শশধর বলে গেছে,শৈল আমার তো সময় লাগবে। তোমরা সাবধানে থাইক।পোলাটার দিকে খেয়াল রাইখ।কুমির নাকি দেখা যাইতেছে গাঙের ধারে কাছেও।ধাইরা গুলারে ঠিক মত খাইতে দিও।আজ সে ফিরবে প্রায় অপসৃয়মান সূর্য যখন পাটে নামবে তখন।

বড় নৌকায় শশধর,বিমল,রবীন,হাবলু ,রহিম শেখ আর জালালউদ্দিন গেছে।বড় ভারী নৌকা,ওটা সামলে মাছ ধরার কাজ করতে এতগুলো লোকেরই দরকার।নদী যেখানে খাঁড়ি মত হয়ে গেছে,দু'পাশে ঘন সবুজ বন ঝুঁকে পড়ে পরস্পরকে চু্ম্বনের চেষ্টায় ব্যাপৃত ;সেখানে গিয়ে ওরা বাস গাড়ে।সে আর এক গল্প।পরে আাসা যাবে।

ৰেশ কয়েকটা কাঁকড়া যখন খাওয়া হয়ে গেল ভোঁদড়গুলোর, তখন ফিরতে  মনস্থ করল শৈলবালা। নাম ধরে ডাকল ভোঁদড়গুলোকে এ্যাঁকা!ব্যাঁকা! চল্ চল্,অনেক হয়েছে,এবার ঘরে চল্।পুরুষ দুটো ভোঁদরকে ওরা এ নামেই ডাকে।ওদের সর্ব সমেত, পুরুষ আর স্ত্রী মিলে চারটে ভোঁদড়।স্ত্রী ভোঁদড় জিকা এখন গর্ভবতী ক'দিনের ভেতরই বাচ্চা হবে দু'টো কি তিনটে। সব ভোঁদড়েরই গায়ের তেলতেলে ঘন লোম হাল্কা বাদামি রংএর কখনও বা কুচকুচে কালো,গলা আর পেটের দিকটা সাদাটে।স্তন্যপায়ী  জন্তুগুলো শৈলবালার ডাকে বুঝতে পারে ওদের এখন ফিরতে হবে।গলায় বাঁধা রশিতে টান পড়ে। রশিটা বুকের নীচে দিয়ে সামনের দু পায়ের জংঘা সন্ধি বেড় করে গলার সাথে বাঁধা থাকে।তাই ভোঁদড়গুলোকে জেলেরা সামলাতেও পারে আর রশির ঘষায় ওদের গলাও ক্ষত- বিক্ষতহয় না। ওরা এখন ঘরমুখি
  । ওদের তীক্ষ্ন চীৎকারে কান ঝালাপালা  হয়ে যাওয়ার যোগাড়। ঘরের পেছনে স্যাঁতস্যাঁতে  ঘন ঝোপের তলায় জিকা গাছের গুঁড়ির সাথে ওগুলোকে বেঁধে শৈল যাবে নদী পাড়ে।এই জিকা গাছটার তলায়  মাদি ভোঁদড় জিকার জন্ম হয়েছিলো। নদীর জলে একেবারে কিনার ঘেঁষে জল-কলমি আর টোপা পানার ঝাড়ের ভিতর পাতা কুঁড়ো জাল থেকে শৈল  কুচোমাছ যা দু'চারটে পাওয়া যায় তুলে আনবে। ইন্দুমতি -শৈলর পিস-শাশুড়ি তখন দুধ নিয়ে বিলি করতে যাচ্ছে মুসলমান পাড়ায়। সে সেখানে নিকারি সামসু মিঞা আর সাহেদ মাষ্টারের বাড়ীতে কখনও পোয়াখানেক কখনও বা আধসের আন্দাজ দুধ দেয়।কখনও বা পাঁচমিশালি শাক নিয়ে গেলেও দুটো পয়সা জোটে।বিত্তবান সামসু বা সাহেেদের স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা এগুলো খুব পছন্দ করে।

আগামীকাল শশধর বেরুবে ভোঁদড় নিয়ে।অনেকদিন ধরে ওর নৌকাটা একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কাদের আসবে নৌকা নিয়ে নদী পাড়ে।এবার সংগী  হবে মুন্সি, গৌরাঞ্গ আর রন্জন।ওরা স্থির করেছে সন্ধ্যায় যখন আযান দেবে আর শাঁখ বাজবে ওরাও তখন যাত্রা শুরু করবে।সন্ধ্যার পর থেকে মাছ বেশী বেশী পাওয়া যায় কে না জানে!বিকেলে শশধর,গৌরাংগ আর রন্জন পূজো দেবে নদী ঘাটে।প্রতি বারই ওরা পূজো দেয় এবার যাবে চিত্রা নদীর বেশ গভীরে,তাই এবার ঘটা একটু বেশী।কালু রায়ের পূজো।কালু রায় কুমির দেবতা।তাকে সন্তুষ্ট করলে কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এই ওদের পরম বিশ্বাস।

শৈলবালা সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছে। রাংতায় মোড়ানো মাটির ঢাল-তলোয়ার,তীর-ধনুক আর টকটকে লাল পোশাকে মাটির ঠাকুর এখন একেবারে যুদ্ধ দেবতা।কাঁসার থালায় বনঝাউ,মুড়কি আর একটু শুকনো খই এর নৈবদ্য সাজিয়ে শৈলবালা এল বড় অশথ্থ গাছের নীচে বেদীর কাছে।শৈলবালার ছেলে জয়ন্ত বাবার রাতে খাবার জন্য এনেছে চিড়ে,মর্তমান কলা আর বোতলে একটু গাই দুধ।পিসী ইন্দুমতি বড় যত্নের সাথে সব গুছিয়ে দিয়েছে।শশধর আর শৈলবালা নৌকার অপেক্ষায়।শশধর বলল,বউ এভাবে তো আর চলে না।আগে  বাড়ীর ধারেকাছে নদীর কিনারায় মাছ মারতে গেলে কিছু মাছ,কাঁকড়া পাইতাম।এখন যে কি আকাল লাগছে!নিরুপায় শৈল খসখসে, কর্কশ হাতটা চিন্তিত স্বামীর পিঠের উপর রাখে, সহমর্মিতা জানায়।খুব মন খারাপ করলে, বা আনন্দিত হলে এক কথায় আবেগ তাড়িত হলে শশধর শৈলবালাকে 'বউ' বলে সম্বোন্ধন করে।ভোঁদড় গুলোর খাবার জুটাবো কোথা থেকে,মাছই তো ধরা পড়ে  না সে পরিমাণ।নৌকাটাও মেরামত করতে পারি না,পোলাপানরে কি খাওয়াব ,কি পিন্ধাব।দিশা পাইনা বউ।শশধরের অসহায় কথাগুলো আর্তনাদের মত শোনায়।শৈলবালার কপালেও চিন্তার দু'টো তাৎক্ষণিক ভাঁজ পড়ে।দৈন্যতা আর অনিশ্চয়তা ওদের বয়সের তুলনায় অনেক বুড়িয়ে দিয়েছে।


ওদিকে কাদের আর মুন্সি ওদের পাড়ার মসজিদে মিলাদ পড়িয়েছে।সামান্যই আয়োজন, মসজিদে উপস্থিত জনের মাঝে বাতাসা বিতরণ।আয়োজন যাই হোক না কেন প্রার্থনা তো অন্তরের গভীর কন্দর হতে!গত সপ্তায় এক মালো জেলে গেছে কুমিরের উদরে।ওরা সবাই রওয়ানা হবে অতি শীঘ্রই। কাদেরের স্ত্রী জোহরা আর ছোট ছেলেটা এসেছিলো ঘাট পর্যন্ত কাদেরকে বিদায় দিতে।ছেলেটার প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে,পোয়াতি বউটারও পরণে বিবর্ণ, ছিন্নপ্রায় শাড়ী।ছ'ছটা ছেলেপিলের বাপ কাদের ।নাঃ এবার ফিরে এসে ও বন্ধ্যাকরন করাবে, মোল্লাদের কুযুক্তিতে ভুলবে না,ভাবে কাদের। ভগ্নপ্রায় হীনস্বাস্থ্য বউটার দিকে চাওয়া যায় না। ।ওর খাবার এসেছে বাড়ী থেকে। একটুখানি মলা মাছের চচ্চড়ি খূব ঝাল করে রান্না। জোহরা রাঁধে ভালো,যেন অমৃত-- কাদেরের নিজস্ব মূল্যায়ন। মুন্সি সদ্য বউ তালাক দিয়েছে।বৃদ্ধ বাবা স্ত্রীর রান্না করা শুটকি-বেগুনের তরকারি আর মোটা চালের ভাত,এককোণে দু'টো কাঁচামরিচ দিয়ে সাজিয়ে ছোট টিফিন বাটিতে করে এনেছে ছেলে মুন্সির জন্যে।গৌরাংগ আর রন্জনও রাতের খাবার এনেছে বাড়ী থেকে।

ভোঁদড়ের বাক্স তোলা হলো নৌকায়। চার ফালা করে কাটা মোটা বাঁশের ফালি পাশাপাশি বেঁধে বানানো বাক্স,ডালাটা উপর দিকে খোলা যায়।একজোড়া ভোঁদড় শশধরের আর একজোড়া মুন্সির।ভোদড়গুলোকে রাখা হয়েছে এই বাক্সটার ভিতর। শশধরের জিকা নামে ভোঁদড়টা আজ কালের ভিতর বাচ্চা বিয়াবে তাই জোড়াটাকে রেখে আসতে হলো বাড়ীতে। এবারের বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটে খানিক বড় হলেই  আনিসের কাছে  বিক্রি করবে,কড়ার হয়েই রয়েছে। বাচ্চা ভোঁদড়গুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শশধর মাছ ধরা শিখাবে। ভোঁদড় প্রশিক্ষণের কৌশল তো আর সবাই জানেনা ।এ বাবদও বেশ কিছু নগদ আসবে হাতে।

 মাছ বিক্রির টাকা আনুপাতিক হারে বন্টন হবে ওদের সবার মধ্যে। সিংহভাগ পাবে কাদের মিঞা। এর পরের বড় অংশ হবে শশধরের, ও যে মাছ ধরার জাল আর দু'টো ভোঁদড়ের মালিক।সবকিছু তোলা হলো নৌকায়। এক কলসী পানিও নিতে ভুলল না ওরা।শশধর ত্রিকোণাকৃতি জালটার বাঁশের তৈরী একবাহু  ভালো করে বাঁধল লম্বালম্বি করে নৌকার একপাশে।ঐ মুন্সি মজবুত কইরা বাঁধ্ দে।গাযে জোর নাই নাকিরে?শশধর বলে,। বাকি আড়াআড়ি করে বাঁধা দুটো বাঁশের সাথে আটকানো জাল ধরে থাকবে শশধর আর রন্জন।আর  বৈঠায় থাকবে কাদের, ওর নাও  সুতরাং কর্তৃত্ব আর আয়েস তো ওই উপভোগ করবে।লগি নিয়ে দাঁড়াবে মুন্সি।গৌরাংগও থাকবে লগি হাতে।সব কিছু তোলা হলো। লাল সূর্য অস্ত যায় যায়।ওরা সবাই উঠল নৌকায়।শৈলবালা শাঁখ বাজাল,কাদের পশ্চিমমুখো হয়ে আজান দেওয়ার সাথে সাথে ওরা নৌকা ভাসাল নদীতে।
 ভোঁদড় গুলোর চীৎকারে তিষ্ঠানো দায়। খানিক অগ্রসর হওয়ার  পর ওরা ভোঁদড়গুলোকে পেট পুরে খেতে দিল কাঁচা মাছের কাঁটা,কানসা, ফুলকো,লেজ আর ভালো ক'খানা টুকরো।পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে আকাশে, নদীর কাজল কালো জলে চাঁদের ছায়া খানখান হয়ে ভেংগে পড়ছে।কি মোহনীয় রহস্যময়,গা ছম্  ছম্ করা রোমান্চকর,সৌন্দর্যমন্ডিত বেদনা-বিধূর পরিবেশ। দূরে আঁধার নেমে আসা গ্রামগুলোয় মিটিমিটি করে জ্বলছে দু' একটা প্রদীপ।রন্জনের ভরাট গলার মন কেমন করা গানে সবাই উদাস হলো।অবচেতন হৃদয়ের গোপন ভালবাসা,বাস্তব জীবনের প্রেম,স্ত্রী পুত্র কন্যা পরিজনের জন্য মমতা হাহাকার করে উঠল। ওরা অগ্রসর  হচ্ছে ক্রমশ যেন বিভীষিকার দিকে।

মাছ ধরাই ওদের জীবিকা।বিশেষ করে আরও অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের  মৎস্য-জীবির মতই এটি মালোেদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ব্যবসা এবং এটিকে ওরা পূত-পবিত্র  ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করে।সভ্যতার বিবর্তন,জীবনধারণের ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও মান বৃদ্ধি আর শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে আজ পেশার পরিবর্তন হচ্ছে । শশধর,রন্জন,গৌরাংগর মতো নড়াইল, খুলনার অনেক মালো মৎস্য শিকার এবং ভোঁদড় ব্যবহারে উৎসাহ হারাচ্ছে।অনেক মুসলমান জেলে আজ শশধরের  মতই ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করে। এত সমস্যা তবুও শশধরের বর্তমান জীবিকা থেকে সরে আসতে মন চায় না ।সেই কোন্ শৈশব থেকে বাবা-কাকাদের সাথে কালে ভদ্রে ঠাকুরদার সাথেও শশধর ভোঁদড় নিয়ে মাছ ধরতে গেছে।জল,জলজ প্রকৃতি আর মাছের সাথে,মাছ ধরার নিবিড় কৌশলের যে এক মাদকতা ওর রক্তে এবং হাজারো জাত জেলের রক্তে তা তারা এড়িয়ে যাওয়া কি এতই সহজ।কি এক উন্মাদনা হাতছানি দেয় অহরহ।

অনকখানি ভাটির দিকে আগিয়েছে নৌকা।ওরা গলায় রশি বাঁধা ভোঁদড়ের বাক্সের ঢাকনা খোলার সাথে সাথে বোঁটকা গন্ধের ভোঁদড় চারটে বেরিয়ে এলো।ওদের জলে নামিয়ে দিয়ে সবার অপেক্ষা কখন মাছ ধরা পড়বে জালে। প্রশিক্ষিত ভোঁদড়গুলো দ্রুত সাঁতরে,তাড়িয়ে নিয়ে আসে জালের দিকে দিশেহারা মাছের দলকে।উত্তেজিত রন্জন বলে,দাদা কিবা মনে হয়।অন্ধকারে আনন্দোজ্বল শশধরের  চকচকে চোখ না দেখতে না পেলেও ওর ভাষায় যা বোঝার রন্জন বুঝে নেয়।শুধু কি রন্জন আর শশধর, নৌকার সবাই বোঝে আজ ভাগ্য সুপ্রসন্ন।শশধরের ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার অভিঞ্জতা অনক সমৃদ্ধ।তিন বারের জালেই প্রচুর মাছ পাওয়া গেছে।নৌকার পেটের খোলে মাছগুলো খল বল করছে।দুটো মাঝারি আকৃতির চিতল আর পাঁচটা বোয়ালও ধরা পড়েছে,আর ছোট মাছ, সেতো বেশুমার।পূর্ণিমার রাতে মাছও জলকেলি করতে পছন্দ করে শশধর  জানে আর তাই এটি মাছ ধরার উপযুক্ত সময়।

শশধর বলে,কাদের ভাই নাওটা আর এট্টু ভাটির দিকে লন,ওইখানে যেখানে নল-খাগড়ার বড় ঝোপ, ঔখানে তিন চারটা জাল মারব,তারপর আর চিন্তা নাই। খিদা পাইছে কাদের ভাই,আমি দুইটা খায়া নেই।খাওয়ার মাঝখানেই ও চিন্তাপ্লুত হয়।মাথা ঝাঁকিয়ে আপন মনেই ভাবতে থাকে..আসছিলো তো শহর থেকে কত সাহব-সুবো।কত কথা কয়া গেল,ছবি নিল।সুন্দর সব্বড় মাপের কথা কিছু শশধরা বুঝল কিছু বা না।কত স্তোক দিয়া গেল,তরপর যে লাউ সেই কদুই।কাপড়ের খুঁটে মুখ মুছল শশ।

বুভুক্ষ ভোঁদড়গুলোকে শিকার করা কুচো চিঁংড়ি,তিত্ পুঁটি আর কাঁকড়া দিলে মহানন্দে তীক্ষ্ন চীৎকার করতে করতে সবই খেয়ে নিল।

নৌকার ছইএর নীচে বসে কাদের আর মুন্সি ওদের মুখরোচক খাদ্য খাচ্ছে হাপুস-হুপুস করে।গৌরাংগ হাল ধরেছে।ওরা সবাই আনন্দিত। রন্জন এবার  গান ধরে আনন্দের।সবাই পুলকিত।কাদের ভুড়ুক ভুড়ুক করে তামাক টানে।

সবার খাওয়া শেষ হলো। শ্রান্ত চাঁদ আকাশের দেয়ালে হেলান দিয়েছে।ওরা  নলখাগড়ার কাছাকাছি এসে জাল নামাল,ভোঁদড়গুলো ঝপাং করে পানিতে নামল।ওরা তড়িৎগতিতে বনে ঢুকল।তাড়িয়ে নিয়ে মাছগুলোকে ঠেলে পাঠালো জালের ভিতর।রন্জন আর শশধর জাল টেনে উঠালে অতি উৎসাহি রন্জন,গৌরাংগ আর মুন্সি চীৎকার করে উঠল আনন্দে।কাদের বলে উঠল কিরে কি মাছ!আরে দেখেন না এদিকে আইসা। কাদেরের আর আসতে
হলো না,প্রচণ্ড এক টালমাটাল ধাক্কায় ওরা কে যে কোথায় ছিটকে পড়ল।শশধর নলখাগড়ার বিশাল ঘন ঝোপের ভিতর পড়ে সম্বিৎ হারাল।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন সকাল হবো হবো,সমস্ত শরীরে আর একটা চোখে প্রচন্ড ব্যথা।ধীরে ধীরে নলখাগড়ার বন সরিয়ে সে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল।চারপাশে ঘনঝোপ,বোধহয় কোন বসতি নেই ।সংগী -সাথি মায় নৌকাটার পর্যন্ত হদিস নেই।রশিবাঁধা ভোঁদড়গুলোরও দেখা নাই।ওর মনে পড়ল পানির দিকে ঝুঁকে ও দলবদ্ধ মাছের সারি দেখছিলো,নলখাগড়ার এক্কেবারে কাছাকাছি।হঠাৎ প্রচন্ড এক ধাক্কায় ঝপাস করে নলখাগড়ার  ভিতর জলে পড়ল।জলের  ভিতর প্রচন্ড আলোড়নের শব্দে তার অবচেতন মন বিপদের সংকেত পেল।অতি দ্রুততার সাথে সে হাচড়-পাঁচড় করে ধারাল খোঁচা খোঁচা নল-খাগড়ার ঝোপের ভিতর ঢুকে গেল।তারপর আর কিছু তার মনে নেই।

শশধর খুব ঘামছিলো।প্রচন্ড গরম আর  ক্লান্তি অনুভবে সে ভিজে লুংগির খুঁটটা দিয়ে মুখ মুছল।তার বাঁ দিকের গাল বেয়ে  একটা লোহিত ধারা নেমে মিশে গেছে,তার কর্দমাক্ত শরীরে।ফোলা বাম চোখটা বন্ধ এবং প্রচন্ড বেদনায় টনটন করছে।ওর নিজ স্ত্রী- পরিজনের কাছে ফিরতে হবে।ফিরতে হবে আপনার  ক্ষুদ্র 'বাবুই' কুন্জে।কাছেই রন্জন পড়ে আছে নিথর নিস্পন্দ।

No comments:

Post a Comment