Friday 12 August 2016

সখি ভালবাসা কারে কয়

আমরা ক'জন একসাথে বসে গল্প করছিলাম তখন গমগমে ভরাট কন্ঠে  হঠাৎ সোহেল গেয়ে ওঠে,'সখি ভালবাসা কারে কয়'।রবীন্দ্র সংগীতের প্রথম কলিটা সবে ঠোঁটে তুলে নিয়েছে বড় গভীর আবেগে আর ঠিক তখনই মুখ ঝামটা দিয়ে মুখরা কাকলি বলে ওঠে,এ্যাই,থাম্ তো।ভালবাসার তুই কি বুঝিস রে,দেখিস তো কতকগুলো হিন্দি আর বাংলা বস্তা পচা সিনেমা আর গিলিস তো কতকগুলো বটতলার উপন্যাস।থাম এবার।

সোহেল খিঁচিয়ে ওঠে,'ম্যালা ফ্যাঁচফ্যাচঁ করিস না।দু'দিনের বৈরাগী ভাতকে বলে অন্ন।ভারী দু'কলম শীর্ষেন্দু,রবীন্দ্রনাথ আর কি সব পড়ে এক্কেবারে পাকামো হচ্ছে।

আঁতেল হিমাদ্রি বলে,শোন্,তোরা খামোকাই  ফ্যাসাদ করিস না।বেশ জম্পেশ করে বোস্,বলি তোদের ভালবাসা কাকে বলে।আঁতেল হিমাদ্রির কথা ওরা বন্ধুরা কখনই হেলাফেলা করে না।

হিমাদ্রি শুরু করে,'সেবার গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি যাচ্ছি।'সুপার' পরিবহনের বাস্।প্রচন্ড গরম। ঊর্ধ্ব গগনে  মার্তন্ড মহাশয় একেবারে রেগেমেগে ফর্টি- নাইন।বাসের যাত্রীরা সব ঘেমে নেয়ে উঠেছে যেন।গরমে আর ঘামের গন্ধে বাসের পরিবেশ হয়েছে নরক।বাসে আমার পাশের জোড়া আসনটিতে বসেছেন এক প্রৌঢ় আর তার প্রৌঢ়া স্ত্রী।স্বামীটি বসেছেন জানালা ঘেঁষে।ঘুম কাতুরে মহিলা বাসে উঠেই আসনের পেছনটায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।সে কি যে সে ঘুম!একেবারে কুন্ভকর্নের ঘুম।জানালা গলিয়ে রোদ এসে গা পুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে কিন্ত্তু মহিলার কোন বোধ নেই।আশ্চর্য হলাম,পুলকিত হলাম,আবেশে মাথা নত হলো পুরোটা সময় ভদ্রলোক জানালার  দিকে পিঠ দিয়ে রোদ ঠেকালেন।স্ত্রী ঘুমিয়ে রইলেন ভালবাসার শীতল ছায়ায়!

রওনক ওদের সবার চাইতে একটু ভারিক্কি ধরণের।বলল, 'থাম থাম তোরা
তো শুধু ভালবাসার একটা দিকই দেখেছিস।গত শীতে গেছি পিকনিকে আমাদের পাড়া থেকে।কেউ কেউ আবার নিজ নিজ বন্ধু-বান্ধব কেও আমন্ত্রন জানিয়েছে।পরিচয় ও কুশল বিনিময় পর্ব চলছে চেনা অচেনাদের মধ্যে।এক ভদ্রলোক এসেছেন তাঁর ষোড়শী কন্যাকে নিয়ে।পরিচয় আদান-প্রদানের পর্বে ভদ্রলোক পরিচয় দিচ্ছেন নিজের ও কন্যার।কন্যার দিকে তিনি আবেগ আপ্লুত দৃষ্টিতে তাকালেন। চোখ দুটো তাঁর ভালোবাসা আর গর্বে মাখামাাখিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।কোন এক আলো যে ধ্রুপদী  নাচ নেচে গেল তাঁর চোখ দুটোয়।আলাপের ফাঁকে চোখ থেকে চশমা খুলে কন্যার ওড়নার প্রান্তে মুছে নিলেন।আমি প্রত্যক্ষ করলাম এক স্বর্গীয় প্রেম পিতা ও কন্যার মধ্যে।


শোন আমি শোনাই তোমাদের  ভ্রাতৃ প্রেমের কাহিনী,বলল আহমদ।দু সহোদর।দুজনা দুজনার প্রাণ।বছর পাঁচেকের বয়সের তফাৎ।স্কুল পড়ুয়া ভাই দুটির  কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না। পিতৃহীন ভাই দুটি দরিদ্র মায়ের ছিন্ন আঁচলের আশ্রয়ে তরতর্ করে বেড়ে উঠছে মফস্বলের বস্তিতে।খরো চৈত্র মাসে কি ভাবে যেন আগুন লাগে বস্তিতে।আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে পুরো বস্তি।দুঃখি মা কোথায় গিয়েছিলো কাজে ।বড় ভাইটি সামনে দোকানে ফুট -ফরমাস খাটছিলো।আগুন দেখে এক ছুটে ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত ছোটভাইকে বুকে জাপটে বেরিয়ে এল বটে কিন্তু ততক্ষনে নির্দয় আগুন তাকে গ্রাস করেছে।

আমি বললাম,আমি তোদের আর এক কাহিনী শোনাই।গ্রাম্য সালিসি ও সমাজের অত্যাচার এবং জটিল মনস্তত্বের কাহিণি।মানুষের মনের নাগাল পাওয়া ভাই ভারি দুরূহ ব্যাপার।মাস দুয়েকের শিশু সন্তান নিয়ে দরিদ্র  যুবক কৃষক ও কিশোরি কৃষাণীর সুখের সংসার।কথায় বলে না রাগ হলো চন্ডাল।তুচ্ছ কারণে সেই চন্ডাল পেয়ে বসল কৃষককে।কৃষক রাগে কাঁপতে কাঁপতে চীৎকার করে কৃষাণীকে দিয়ে দিল তালাক।আর যায় কোথায়।পাড়ার
লোকজন,মাতবর সেই তালাক কার্যকর করায় এক কাপড়ে শিশুপুত্র সহ স্ত্রী গৃহত্যাগ করল।সবাই হৈ হৈ করে উঠলো,'এ্যাই ভিন্ন প্রসংগে যাচ্ছ কেন?আমি বললাম,না প্রসংগ পাল্টাইনি ধৈর্য ধর।তারপর এই যুবক ও কিশোরি তাদের জীবন অতিবাহিত করল  বড়ই কষ্টে,সংগীবিহিন।আমার বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে,তুই এত কথা জানলি কি ভাবে। আরে্ ঐ  প্রৌঢ়ত্বের শেষ কোঠায় পৌঁছানো মহিলা তখন আমাদের ঘরে ঠিকা কাজ করত যে।একসময় মহিলার স্বামী ও যুবক ছেলে শহরে এসে হাজির।মহিলা পরম মমতায় শাক-ভাত,পাতে একখানি কাঁচামরিচ সাজিয়ে বুড়োর সামনে সাজিয়ে ঘোমটায় মুখ ঢেকে খানিকটা দূরে বসে থাকত।লোকটি যে পরপুরুষ,তার স্বামী নয়। কখনও নিজে অভুক্ত থেকেও বুড়োকে খাওয়াত। প্রশ্ন করলে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বলত,'সবই অদেষ্ট'। সবাই বিষণ্ণতায় খানিক চুপ কর থাকল।

একসময় নীরবতা ভংগ করে হায়দার বলে,তবে শোন তোরা আমার আপন খালা খালুর গল্প।আমার মায়ের আপন বোন লীজা খালা,মায়ের ছ' বছরের ছোট।খালা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং পড়াতেন।তো লেখাপড়া করতে করতেই তিনি প্রেমে পড়লেন।পড়বি তো পড়্ একেবারে ঘাড় মাথা মুড়িয়েই পড়লেন।প্রেমে পড়লেন আমাদের খালুর সাথেই।তো সে প্রেম এক অনবদ্য কৈশোর প্রেম।খালা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থি আর খালু উচ্চ মাধ্যমিক।আট বছরেরও বেশী সময় প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার পর অবশেষে নৌকা ঘাটে ভিড়ল।প্রেমের বিয়ে হলে কি হবে প্রতিদিন মান-অভিমান, ঝগড়া-ঝাঁটি লেগেই থাকত।আবার কি ভাবে যেন মিটমাটও হয়ে যেত।সেই খালা বলা নেই কওয়া নেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন হঠাৎ।হাসপাতাল থেকে মরদেহ যখন বাসায় এল,খালু একবার শুধু তাকিয়ে বললেন,'লিজা তুমি যাও আমি আসছি।তারপর ধীরে সুস্থে বিছানায় গিয়ে শুলেন।মরা বাড়ীতে সবাই ব্যস্ত।তারই এক ফাঁকে খালার বড় মেয়ে খালুকে ডাকতে গিয়ে দেখল খালু নেই-চলে গেছে-খালার কাছে -তার লিজার কাছে।সবার মন ভারাক্রান্ত হল।

কলেজের দুপুরের একঘন্টা বিরতির সময় শেষ হল।সবাই চললাম যে যার ক্লাসে।মনে বেশ অনুরণন চলল খানিক সময় ধরে ভালবাসার বিভিন্ন ঘটনাগুলো নিয়ে।

No comments:

Post a Comment