Friday 2 December 2016

দ্বৈধ

আমি দ্বিধাণ্বিত  ভেংগে চুরমার হওয়ার উপক্রম এক পুরুষ।লোকে আমাকে বীর পুরুষ বলে আখ্যায়িত করে।আমি হেঁটে গেলে তারা পথ ছেড়ে দাঁড়ায়।আংগুল উঁচিয়ে ফিস ফিস করে বলে বীর'---'।শেষে আমার নামটা জুড়ে দেয়, বলে দেখ কত সাহস,কি দেশ প্রেম,কোন কিছু পরোয়া করে না।কিন্তু ওরা তো জানে না প্রতিমূহুর্তে আমি ক্রমশ ভেংগে পড়ছি।আমি কত অসহায়,মানসিক ভাবে কত দূর্বল,কত সামান্য ,কত গতানুগতিক।

আজ আমি স্বনামধন্য এক যুদ্ধক্ষেত্র ফেরৎ যুবক।রণাংগনে পা হারিয়েছি।সমাজ সংস্কারে ব্যস্ত।বিখ্যাত এক বিদেশী অনুদান প্রাপ্ত সমাজ কল্যাণ সংস্থায় উচ্চ পদে কাজ করি ।কত বারাংগনা, কত যুদ্ধশিশু আমার নেতৃত্বের ছায়ায় শান্তি খোঁজে।তাদের কারও কারও পরিপূ্র্ণ সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি কারও বা আংশিক। সবাই আমাকে ঈশ্বর বা ফেরেশতার আসনে বসিয়ে রেখেছে। নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে কত ধরণের সমস্যা আর কত ধরণেরই না সমাধান। আর সব  কিছুর যে সমাধান করা সবসময় সম্ভব তা নয়।যেমন আমি নিজের সম্যসার সমাধান আজও করতে পারিনি।শ্বেতাংগিনী সহকর্মীনি মার্গারেটা বলে,ওকে দত্তক নিয়ে নিলেই তো পার ?সবই তো তুমি করছ ওর জন্যে। ওর  জন্য তোমার এত ভালবাসা। কিন্তু আমি যে আমার মনের সাথে যুঝে চলেছি নিরন্তর,নিরবধি।ওকে অর্থাৎ বিজয়িনীকে-বিনিকে আমি ভালবাসি।ও এরই মধ্যে পাঁচে পা দিল।কি সুন্দর নজর কাড়া চোখ, মুখ।মায়ের চেহারা যেন কেটে বসানো।চোখের কোল ঘেঁষে তিলটা অবধি ও যেন আইশার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসেছে।

ওর মা আইশা ছিল অপরূপা,তবে খাটো।এ নিয়ে ওর দুঃখের অবধি ছিল না।যতই না বলি দেখ আমিও তো খাটো,আর আমি কি রূপবান? কিন্তু আমাদের সম্পর্ক তো অটুট।আমাদের মানসিক যে সেতু বন্ধন তাতো পলকা নয়। দুর্জয় সাহস আর প্রচন্ড জেদ আমাকে রণাংগনে ঠেলে দিয়েছিলো।কিন্তু সত্যি বলতে আমি খুব কোমল প্রকৃতির ।

এই তো এখন বিনি আমার দুপায়ের মাঝখানে ঢুকে বিড়াল ছানার মত কোলে মুখ গুঁজে আছে।ওর যতক্ষন মন চাইবে ও ততক্ষণই এভাবে থাকবে।বাধা দেওয়ার কায়দা আমার জানা নেই।আমার নাম জানে।বলে তোমার নাম এমন কেন? কেমন?-আমি বলি।এই যে সেলিম।তা খারাপ কি?না কেমন যেন।আচছা পিতা আমার মা কোথায়?ওই যে কমলিকা,সেরিনা,নাজমা,বিজরী ওদের তো মা আছে।আমার নেই কেন?আমি নিরুপায় হয়ে বলি ওদের মাকে কি দেখেছ?কমলিকার মা তো মাঝে মাঝে আাসে-বলে বিনি।জিঞ্গাসা করি বাকি ওদের মা?আসবে,আসবে তো,ওরা বলেছে;চকলেট,আরও অনেক কিছু নিয়ে আসবে,ওদের কোলে বসিয়ে অনেক অনেক আদর করবে। কিন্তু কবে আসবে ওদের মা এর উত্তর ওর সংগীদের যেমন জানা নেই আমারও তেমন  বলার উপায় নেই।আর বিনিই বা কেমন করে জানবে  যে ওদের মায়েরা যে হারিয়ে গেছে জনারণ্যে নতুন জীবনে।তাদের জীবনের এই কালো অধ্যায়  তারা ভোলার চেষ্টায় ব্যাপৃত।আর কেউ কেউ তো আশ্রয় নিয়েছে বারবণিতা পল্লীতে ,আঁকড়ে ধরেছে পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা।আমরা তাদের সমাজে ফিরিয়ে এনে পুর্নবাসিত করতে চেয়েছি কিন্তু বেলোয়াড়ি চুড়ির মতো পল্কা মানসিকতার তারা আর তা পারেনি। বিনির তো এসব বোঝার কথা নয়। আচ্ছা পিতা তুমি তো অনেক কিছু জান।তুমি কি বলতে পার মা আকাশের তারা হয়ে গেল কেন?রীটা(মার্গারিটা) বোধ হয়
এসব জ্ঞান দিয়েছে।

আবার বলে যে সব বাবা খারাপ তারা না থাকাই ভাল।আমি জানি কমলিকা,সেরিনা ওদের বাবা পচা।আমার পিতা ভাল।চোখ ভিজে ওঠে,হায়রে অবোধ শিশু আমার মনে যে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে!আমি কি করে বোঝাই আমি তো ওর পিতা হয়েই থাকতে চাই সারা জীবন কিন্তু মাঝখানে যে একটা কাঁটা সর্বদা খোঁচাচ্ছে।বাবুল মিঞা কেয়ার টেকার অত্র প্রতিষ্ঠানের, বিনি মা-মনিকে আমাকে পিতা বলে ডাকতে শিখিয়েছে।কেন কে জানে!সবই কি আল্লাহ্ বা ঈশ্বরের নির্দেশিত?বা একেবারেই প্রহসন!

সেই যে বলছিলাম আমি ছোট খাট খুবই সাধারণ চেহারার যুবক,বাহ্যিক সৌন্দর্যে কাউকে আকৃষ্ট করার মত কিছু গুণ আমার নেই কিন্তু আজ এত বড় প্রতিষ্ঠানের প্রায় কর্ণধার হয়ে বসে আছি।আমার মতামতের অনেক মূল্য।দেশের তাবৎ বড় বড় মন্ত্রী উপমন্ত্রীদের সাথে আমার ওঠা বসা।অনেকেই জানে আমাকে,ভীষণ কঠিন,কঠোর তবে ন্যায়পরায়ণ একটি মানুষ বলে।ক্ষুরধার আমার বুদ্ধিতে অনেক সম্যসার চমৎকার সমাধান করি ক্ষণিকে।

আমার আর আইশার দেখা হওয়া একটা দৈবাৎ ঘটনীয় ঘটনা।আমার বোন মিলি আর ওরা কয়েক বান্ধবী -অন্জলি,আইশা,খালেদা,টুম্পা,রেমা একসাথে ঘুরে বেড়াত।এমনই একদিন ওরা কয়েক বান্ধবী মিলে গোল হয়ে এনামেলের সাদা বাটিতে ক কি যেন খা্চ্ছিল।হঠাৎ মাথায় কি দুর্বুদ্ধি চাপল আইশার হাত থেকে বাটিটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলাম।প্রায় বিদ্যুের গতিতে আইশা দাঁড়িয়ে আমর দিকে তাকিয়ে বলল নিলেন কেন?ওর চোখের দৃষ্টির সাথে আমার চোখের দৃষ্টির মিলন ঘটল না কি ঘটল জানিনা আমার শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ স্ফুলিংগ প্রবাহিত হলো।আমি তখন মাত্র অষ্টম শ্রেণীতে আর আইশা চতু্র্থ শ্রেণীতে।বলতেও লজ্জা হয় এই বয়সে প্রেম--ইঁচড়ে পাকা কোথাকার।কিন্তু অঘটনপটিয়সী রসিক কিউপিড তো ততক্ষনে দূর্ঘটনা যা ঘটানোর ঘটিয়েই দিয়েছে।আইশা তো তখন নিতান্তই বালিকা।তবে আমার তো ভালো হোক মন্দ হোক যা হবার হয়েই গেছে। ঘটনা এখানেই থেমে গেলে আজ বিনিরও জন্ম হত না আমিও এই দুর্বিষহ জীবন যাপন করতাম না। ভবিতব্য কি খন্ভানো যায়!

এরপর থেকেই আইশা যখন তখন আমদের ঘরে আসতে শুরু করল।অলক্ষ্যে দুটো বরই কি একটু আচার টেবিলে রেখে যেত।কখনও বা পেছন থেকে এসে পিবিয়েঠের পর কচি হাতের আচমকা একটা কিল দিয়ে চলে যেত।এই লুকোচুরির খেলা চলল বহুদিন।ক্রমে আমি কৈশোর হতে যৌবনে পা দিলাম ।আইশাও ততদিনে  একটি অপরূপ কিশোরী  হয়ে উঠেছে।আমাদের এই বাঁধ ভাংগা প্রনয় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল।তবে বোধ করি যুগ এবং পারিবারিক রক্ষণশীলতা শিক্ষার কারণে আমাদের সর্ম্পক কখনও সীমা লংঘন করেনি।ইতিমধ্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ,এ পড়ছি আর আইশা প্রথম বর্ষ বি,এস ,সি পড়ছে।

অফিসে কাজ করছিলাম,নজর পড়ল দরজার দিকে।দেখি বিনি উঁকি দিচ্ছে সভয়ে।আমি বললাম-এসো বিনি কিছু বলবে।পিতা একটা পুতুল কিনে দেবে।ওকে কিনে দেওয়া মানে ওর সংগী সাথীদের সবাইকে একটা করে কি নে দেওয়া।বিনির পেছনে আড়ালে পঞ্চাশোর্ধ বাবুল মিঞা দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারি।

এরপর দেশ জুড়ে পাকিস্তানী আর্মির নর হত্যা আর ধ্বংস  যজ্ঞ শুরু হয়েছে।
স্থির করলাম না ভুল হলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম ভারতে পলাব এবং যুদ্ধের ট্রেনিং নেব পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথ সম্মুখ সমরের জন্য।আইশা জানত কিন্তু কোনরকম বাধা দেয়নি ।তবে সে জেদ ধরল  বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে।আমি যতই তাকে বুঝাই যুদ্ধক্ষেত্র এক অনিশ্চিত জায়গা হত আমর মৃত্যুও হতে পারে।না সে অনড়।অবশেষে যে রাত্রে আমরা পালাব সেই দুপুরে আমরা বিয়ে করলাম এক কাজী অফিসে।আমর বোন মিলি,বান্ধবী খালেদা আর আমার দুই বন্ধু সাহেদ আর পিয়ারের সাক্ষীতে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।দিনে দুপুরে আামাদের বাসর হলো সাহেদের বাসায়।ওর বাবা মা ,ভাই বোন ভয়ে গ্রামের বাড়ীতে।

রাত নটার দিকে আমি,সাহেদ,পিয়ার আরও দুটো ছেলে পালালাম বাড়ী থেকে।আমাদের  ওপারে পৌঁছাতে লাগল প্রায় দিন পাঁচেক।প্রায় দিন পনের পর খবর পেলাম যে রাতে আমরা পালালাম সেই রাতেই আমাদের বাড়ীসহ আরও কয়েকটি বাড়ীতে পাক আর্মি ও স্থানীয় বদমাশরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আরও খবর পাই বাধা দেওয়ায় আমার বাবা মা ও বোন টা প্রাণ হারায়।ভাইটা পালিয়ে বেঁচেছিলো কিন্তু স্বাধীনতার পর সে হয় হাইজাকার ও ডাকাত।এবং পরে তৎকালীন আইন রক্ষাকারি বাহিনীর হতে মারা পড়ে। শুনতে ও বলতে খুব নিষ্ঠুর  হলেও ওর মৃত্যুতে আমি খুব স্বস্তি ও শান্তি পেলাম।এরকম কুলাংগার বেঁচে থাকার চেয়ে মারা গেলেই তো সংসার,সমাজ , দেশ ওপৃথিবীর জন্য মংগল।ওর মৃত্যুর পর আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম।যে ভাইটাকে এত ভালবাসতাম, যাকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে আগানে বাগানে ঘুরেছি,যে প্রায়ই আমার হাতের চটকানা খেত আমার ডাক টিকিট চুরির দায়ে  সে ভাইটা চলে গেলে আমি হয়ে গেলাম নিসংগ,বিরাট এক ধ্বস নামল আমার মানসিক অবস্থায়। ঠিক এ সময়টাতেই দেখা পেলাম বিনির।আইন রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকে প্রস্তাব দিয়েছিলো আমি একটু সম্মতি দিলেই ভাইটিকে দেশ থেকে পালানোর ব্যবস্থা তারা করে দেবে,তবে পরিবর্তে আমাকে কয়েকটি  অন্যায় শর্ত মেনে নিতে হবে।শর্তও মানতে পারিনি প্রাণের দোসর ভাইটিকেও বাঁচাতে পারিনি।

বিনিকে পেয়ে আমার হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেলো।আমার আলোড়িত হৃদয়ে তোলপাড় ফেলে দিল বিনির কৃষ্ন কালো দীর্ঘ চক্ষু পল্লব।কত শক্তি ধরে তার বন্কিম ভ্রু-যুগল।বিনি যেন আমায় নতুন জীবন দিল।কিন্তু সেই সাথে যুক্ত হলো দ্বৈধতা।এক নতুন আমি,নতুন সেলিমকে আমি উপলব্ধি করলাম।অনেকে আমায় আড়ালে ডাকে অবধূত হলে। কিন্তু কত হীণ আমি, কতই না নগন্য তার তো সাক্ষী আমি স্বয়ং।
আমি তখন জার্মানীতে।যুদ্ধক্ষেত্রে হারানো পায়ে গ্যাংগ্রীন ধরে।নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার,ভারত সরকার ও জার্মানীর বাংলাদেশী জনগোষ্ঠির সহায়তায় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে জার্মানীতে ।ফিরলাম প্রায় দেড় বছর পর।এসেই খোঁজ করলাম আইশার।  জুন মাসের সেই কালরাতে পাক সেনা এবং তাদের সহচরেরা আমাদের এলাকা থেকে আইশা,খালেদা আরও কয়েকটি মেয়েকে বাংকারে তোলে, তাদের উপর অমানুষিক,বর্বর অত্যচার চালায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মেয়েগুলি শারীরিকভাবে মুক্তি পেলেও তাদের মানসিক বৈকল্য থেকে মুক্তি ঘটেনি ।সন্তান প্রসবের পর আইশা আত্নহনন ছাড়া আর কোন পথ পায়নি।খালেদা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আজও মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এরপর দেখা পাই বিনির।আইশার দেওয়া নাম বিজয়িনী যার সংক্ষিপ্ত রূপ বিনি।আইশা বিয়ের পর বলেছিলো ওর কন্যা সন্তান হলে নাম রাখবে বিজয়িনি। মনের এই অবস্থায় বললাম,হে বিভু আমায় শক্তি দাও,।মনের এই দ্বন্দ থেকে মুক্তি দাও।হোক না কেন যে কেউ ওর পিতা আমি বা শয়তানের দোসর,কিন্তু  আমার আইশার রক্ত বইছে ওর ধমনীতে।হে বিভু মনের এই দ্বৈধতা থেকে মুক্তি দাও।দেখাও আমায় আলোর পথ,মানবতার পথ,সংস্কারহীনতার পথ।জয় হোক মানবতার-আমার সন্তান বিনিকে যেন দিতে পারি মাথা উঁচু করে বাঁচার ছাড়পত্র।

Saturday 19 November 2016

অদ্ভূতুড়ে

সে ছিল ঘন ঘোর বর্ষার সময়।সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে ঝর-ঝর,ঝর ঝর।'কাঁপে পাতা পত্তর'।কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য যদি বা কমল তাও তা পড়তে থাকল টিপ টিপ,টিপ টিপ।আকাশ তার  সুরমা- কালো মেঘের পর্দাখানি নিয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি নেমে এসেছে,একেবারে কাছে।এত বৃষ্টি কদিন ধরে একটানা,সাথে দমকা বাতাস আর বিজলির খেলা চলছে যে প্রাত্যহিক কাজকর্ম গোল্লায় যেতে বসেছে।আমাদের এবং আর সবার স্কুল থেকে ছুটি ঘোষণা করেছে।স্কুল বন্ধ কি মজা!পড়া নেই কি মজা!কিন্তু সে আর কদিন।প্রথম কদিন ঘরের ভেতরে খেলাধূলো বেশ লাগল।স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা রহস্য বইগুলো পড়লাম কাঁথামুড়ি দিয়ে।ঘন দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া,সূর্য বিহীন মৃদু আলো,ক্ষণে ক্ষণে কড় কড়াৎ বাজের আওয়াজ এমন দিনেই তো রহস্য গল্প জমে ভাল।এক সময় বই গুলোও শেষ হলো,খেলনাগুলো নিয়ে খেলাও শেষ হলো ,কিন্তু বৃষ্টির ঝম ঝমিয়ে পানি পড়ার যেন কোন শেষ নেই।আমাদের বাড়ীটি কাঠের তৈরী,লোকে বলে জাহাজ-বাড়ী।উঁচু উঁচু ,মোটা মোটা কাঠের পায়ার উপর ঘরখানি বসানো।পায়ার আশে পাশে তলাটা ফাঁকা।কুকুর,বিড়ালের দিনের বেলা, অনেক সময় রাতের বেলাতেও নিরুপদ্রপ ঘুমানোর জায়গা।

তিনখানি কাঠের  সিঁড়ি বেয়ে,দরজা পেরিয়ে তবে নীচ তলায় ঢোকা যায়।নীচ তলার মেঝেয় কাঠের পাটাতন দেওয়া।নীচ তলায় মা রাঁধা-বাড়া করেন।আমাদের খাওয়া দাওয়া,পড়াশোনা সবই নীচ তলায়।পাটি পেতে, কখনও বা মোছা মেঝে খানির উপর বালিশ নিয়ে দিনের বেলা আমরা ঘুমুই। ছোট শহর, বাড়ী ঘর এমনিতেই অনেক ফাঁকা ফাঁকা।দোতলা তিনতলা বাড়ীঘর কিছু দেখা যায় বটে তবে বেশীর ভাগই টিনের একচালা দোচালা আর আছে আরও কিছু বেড়ার দেয়ালের ছোটছোট বাড়ীঘর।সারা শহর খুঁজলে এমন জাহাজ বাড়ী  একটি কি দুটি দেখতে পাওয়া যায়।আমার পিতা কি ভাবে যে এমন অদ্ভূত  সুন্দর একটি বাড়ীর সন্ধান পেলেন!খুব গর্বের ব্যাপার আমার জন্যে,বন্ধু- বান্ধবরা মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভূত বাড়ীটি দেখতে আসে।তাদের সবার চোখে একটা ঈর্ষা খেলা করে বেশ বুঝতে পারি।তখন মনে মনে বাবার এই বিশেষ বাড়ীটি পছন্দ করাকে তারিফ করি।আমার বেশ অহংকার হয়,নিজেকে কেউ কেটা একজন ভাবতে ভাল লাগে।

আমার ছোট আর একটি ভাই ও বোন আছে।ভাইটি তো যেন পথ ভোলা এক দেবদূত,ভুল করে আমাদের ছোট্ট কাঠের বাড়ীটায় আশ্রয় নিয়েছে।কি মায়াময় মধুমাখা তার কথাবার্তা,আর কি চমৎকার মন কাড়া নিষ্পাপ হাসি।
নীলাভ সাদায় তিমির কালো পুতলীর, জল টলটলে সদা-অবাক দুটি চোখ।আমাকে ডাকে 'দাম্মা' বলে।ওর 'দাম্মা' ডাকে আমি হই দিশেহারা।কিন্তু আজ কি হল?আমি অবাক হচ্ছি ওর আচরণে।খানিক আগে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল,দাম্মা,আমার ফাই ইন্জি,আমার ফাই ইন্জি।এনে দাও,এনে দাও।ওর জন্যে আমি প্রাণ পাত করতে পারি এমনই ভালবাসি আমি ওকে।বোনটাকেও কি আমি কম ভালবাসি!আমি যেন ভালবাসতে আর ভালবাসা পেতেই জন্মেছি।ভালবাসায় ভরপুর এক স্বর্গ আমাদের এই জাহাজ বাড়ী।কত সকালে ঘুম ভেংগে দোতলার মেঝের লম্বা ফাটা দিয়ে বাবা-মাকে পরস্পরের হাতে হাত নিয়ে চা খেতে দেখেছি।অথবা দেখেছি নির্ণিমেষে পরস্পরের দিকে অপলক চেয়ে থাকতে।আমার ছোট ছ'মাস বয়সের বোনটি আমায় দেখলেই অবোধ্য ভাষায় 'তাতা','তাতি' নানান শব্দ করে দুহাত তোলে কোলে ওঠার জন্যে।কোলে উঠে ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে দিয়ে আরামে আহলাদে বিগলিত কুঁ কুঁ আওয়াজ করে।কিন্তু আজ কি হলো।পৃথিবী হঠাৎ এত এমন বদলে গেল কেন?

ফাই ইন্জি অর্থাৎ ফায়ার ইনজিন নামে খেলনাটির রহস্য উদঘাটনে ব্যাপৃত হলাম।জিঞ্গাসা করলাম,কি হয়েছে তোমার ফায়ার ইন্জিনের?পড়ে গেছে নদীতে।নদীতে?অর্থাৎ পানিতে; অঝোর ধারার বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে।দমকা বাতাস থেমেছে।কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে সবিরাম।আমাদের জাহাজ বাড়ীর নীচের তলাটা দেড় মানুষ সমান উঁচু পানিতে ডুবে গেছে।একতলার ভিতর দিয়ে দোতলায় ওঠার যে সিঁড়িটা সেটা প্রায় তলিয়ে গেছে।বাবা সেদিন অফিস গেলেন নৌকায় করে।দুদিন তিনি আসেন না তাঁর খবরের কাগজের অফিস থেকে; তিনি আসবেন না দু রাত, খুব নাকি কাজ পড়েছে।আশ্বাস দিয়ে গেছেন আগামী কাল বিকেলের মধ্যেই নাকি বৃষ্টি থেমে যাবে আর পানি নাকি দ্রুত নেমে যাবে।বাবা এসব কি বলেন,আমি দেখছি আকাশ মাটির তৈরী পোড়া হাঁড়ির তলার মত ঝুলে আছে পৃথিবীর উপর!কি জানি হবেও বা।বাবা যে পত্রিকা অফিসে কাজ করেন,তারা যে আগাম সব কিছু জানতে পারে।মায়ের ভারী ভরষা বাবার উপর।

আমি ঝাঁপিয়ে পানিতে পড়লাম।কিন্তু খেলনা কই?পানি যে আমার মাথার উপর দিয়ে বইছে।ভাগ্যিস সাঁতার জানি।আনাচে কানাচে কোথাযও নেই।প্রথমে মনে হয়েছিলো বড় জাম্বুরা গাছের গুঁড়ির সাথে আটকে ওটা হয়ত বা ভাসছে।না তা তো নয়।ভাইটার হাসিমুখ দেখতে চেয়েছিলাম,বীরত্ব দেখাতে চেয়েছিলাম।কিন্তু না এবার উঠে পড়তে হবে।এটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।পানির একটা জোরালো টান অনুভব করছি খালের দিকে।এবার উঠব।সাঁতরে দোতলার বারান্দার কাছাকাছি গিয়ে উপরে রেলিং ধরে এক হ্যাঁচকা টানে উপরে উঠতে চাইলাম।বাদ সাধল ছোট ভাই।কতৃত্বের সুরে সে বলল খুঁজে নিয়ে এস ফাই ইন্জি,এখনই উঠছ কেন?চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম।এভাবে তো কখনও কথা বলে না।লক্ষ্য করলাম ওর চোখ দুটো জ্বলছে অংগারের মত।চেহারা হয়ে উঠেছে ভয়ংকর,যদিও ওর আগেকার চেহারার আদলটুকু আছে।আমি আবারও উঠতে চেষ্টা করলাম।এবার আমার ভাই কোথা থেকে একটা লোহার রড এনে আমার আঁকড়ে ধরা হাতের আংগুলে আঘাত করল ।প্রচন্ড যন্ত্রণায় হাত ছেড়ে দিয়ে
আমি একটু তফাতে সরে আসি।এমন সময় মা এলেন ঝুল বারান্দায়।আমি তাঁকে সমস্যাটা জানালাম।মা একটা ক্রুর নিষ্ঠুর হাসি হেসে বললেন,খেলনাটা নিয়ে তবেই উঠবি।মা আমি যে আর সাঁতরাতে পারছিনা।মা বলেন খেলনা নিয়ে তবেই উঠবি,আগে নয়।মা ঘরের ভিতর চলে গেলেন।ভাবলাম এতদিন কোন ভালবাসার ছলনায় তাহলে ভুলেছিলাম।আমি যাদের এত ভালবাসি এরা তাহলে কারা?এরা কি তবে দূরাত্না,প্রেতাত্না।আর একবার রেলিংটা ধরে উঠতে চেষ্টা করলাম।নিমেষের ভিতর কোথা থেকে আমার অত প্রিয় ভাই একটা জ্বলন্ত চ্যালা কাঠ নিয়ে এসে আমার আংগুলে চেপে ধরল।উঃ, মাগো বলে চীৎকার করে উঠে ডুবে যেতে থাকলাম।আমি শ্বাস নিতে পারছি না।একটু বাতাস আহ্ মাগো একটু বাতাস।খুব জোরে টেনে শ্বাস নিতে চাইলাম।দম বন্ধ হে আসছে। এখুনি আমি মারা যাব।

এই তো শ্বাস নিতে পারছি।আমার চোখের দৃষ্টি আমার ঘরের ছাদে। বিছানায  ২০১৬ র নভেম্বর  মাসের ১৫ তারিখে আমি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম।স্বপ্ন দেখছিলাম পঞ্চাশ দশকের পটভূমিকায়।আমাদের কোন জাহাজ বাড়ীও ছিল না আর আমি দুই ভাইএর  পর সর্বকণিষ্ঠ বোন ।স্বপ্ন কত অদ্ভূতুড়ে হয়।আপনারা কি বলেন?

Friday 4 November 2016

শশধর ও কয়েক জন মৌওয়াল

বিছমিল্লাহতেই গলদ। গল্পের নামকরণ কি বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারি?  মৌওয়াল বাহিণী কিন্তু শশধরের নেতৃত্বে পরিচালিত নয়।আর শশধরের সেই অভিজ্ঞতাও নেই মধু সংগ্রহে নেতৃত্ব দেওয়ার মত।তবু শশধরের এই গল্পে মূল চরিত্র হয়ে উঠা কেন অনিবার্য হয়ে উঠল তার  পেছনে  অনেকগুলো শক্তিশালি কারণ আছে বইকি।

এরকম শশধর সমাজে অনেক আছে।এমনই সংগ্রামী,চৌকস,কর্তব্য-পরায়ণ,আর তেমনই ভাবালুতায় আচ্ছন্ন প্রেমিক ও স্বামী।তবু,তবুও লেখকের দূরবীনে শশধরই উজ্জ্বলতায় ভাস্বর।সম সাময়িক বাস্তবমুখি সিদ্ধান্ত গ্রহনে শশধর বড় যুগোপোযোগী এবং মনস্কতায়  অনেকটাই আধুনিক।এটা হয়তো বা দৈবাৎ ঘটনীয় একটা ঘটনা।দূরবীনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু অন্য যে কেউ হতে পারত।

যাই হোক আবার পিছু নেই গল্পের,দেখি গল্প  আমাদের কোথায় নিয়ে যায়।
বেশ কতকগুলো মাস কেটে গেছে শশধরের মাছ শিকারের সময় কুমির কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর।দীর্ঘ সময় হাসপাতালে কাটলেও চিকিৎসক তার বাম চোখটি রক্ষা করতে পারেননি। শশধর বলছিলো চোখটা গেছে,কতগুনা টাকাও গেলো,আমার এখন এই অবস্থা।ঋণে জর্জরিত শশধর আজ  দিশেহারা।

শশধর রওয়ানা হয়েছে মৌওয়ালদের সাথে।কমপক্ষে দু-তিন সপ্তাহের ধাক্কা ভাগ্য সহায় না হলে।তাদের ছয়জনের দল। সংগে আছি আমরা দু'জন। এ সময় মধু সংগ্রহের কাজে বেশ ভালো লাভ হবে-তাদের আশা।শশধর আশা করে বাড়তি টাকাটায় দেনা শোধ করতে পারবে।কপাল ভালো হলে হয়ত নৌকাটাও মেরামত করে নিতে পারবে। সবই ভগবানের ইচ্ছা।এমনটাই ভাবে দলপতি আকবর আলি এবং দলের আরও পাঁচজন।যাত্রার প্রাক্কালে আকবর নদী ঘাটে দু-রাকাত নফল নামাজের মোনাজাতে বলেছিলো' ইয়া গাফুরুর রাহিম তোমার এই গুনাহগার বান্দার সহায় হও।তার জান মালের হেফাজত কোরো।

কম বড় বহর ছিলো না আমাদের।আমি তখন একটা বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছিলাম সুন্দরবনের বিভিন্ন জীব ও প্রকৃতি নিয়ে। আমার সহযোগী  রমেশ গোমেজ আর রাকিব হায়দর আর আমি আবার ওদিকে শশধরের ছ'জন,মাঝি আরও দুজন  সাকুল্যে এগারজনকে নিয়ে যেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সে কথায়  নাহয় আবার পরে ফিরে আসা যাবে।

শশধরের সাথে আমার প্রথম দেখা চিত্রা নদীর কিনারে এক লোকালয়ে শশধরের গ্রামে।তখন কাজ করছিলাম 'বাংলাদেশে ভোঁদড় ও তার পরিসংখ্যান' এর  উপর ।জীববিজ্ঞানের  উপর পড়াশোনা করেও কোন স্থায়ী  চাকুরী জুটাতে পারিনি এমনই অপদার্থ আমি।নানা ঘাটের জল খেয়ে বেড়াচ্ছি আর খোদার খাসীর মত গতর হচ্ছে।

 আমরা দুটি নৌকায় রওয়ানা হলাম মধু সংগ্রহে। চৈত্র মাস তখন তার যৌবন হারিয়েছে।বৈশাখ যেন তখন অনুঢা কিশোরি। এখনই মধু সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।ফাল্গুনে যখন অরণ্যে ডালে ডালে পুষ্পোৎসব হচ্ছিল মৌ পিয়াসী মৌমাছি  তখন ফুল উজাড় করে মধু  আহরন করে গৃহস্থের মত গোলা ভরেছে।কম পরিশ্রম,সময় আর ধৈর্যের ব্যাপার নয় প্রায় আশিটার মত ফুল থেকে উড়ে উড়ে ফুলের মধু সংগ্রহ করা!অনুসন্ধিৎসু জনি  জিঞ্গাসা করে আচ্ছা স্যর ছোট বেলায় তো ফুলের মধু কতই খাইছি,সেই মধু আর মৌচাকের মধুর স্বাদ তো এক না।এমন ক্যান? প্রশ্নটা বুঝতে পারলাম। জানালাম মৌমাছি তার লম্বা নলাকৃতি  জিহ্বার সাহায্যে ফুলের মধু প্রবেশ করায় তার বিশেষ ভাবে প্রস্তুত পাকস্থলিতে।সেখানে ফুলের  জলীয় মধু পাকস্থলির বিভিন্ন পাচক রসের সাথে মিশ্রিত হয়ে ঘন মধু তৈরী হয়।আর তখন মৌমাছি মৌচাকের ছোট ছোট ঘরে  সেগুলো উগলে দিয়ে মোম দিয়ে তালা মেরে দেয়। সবার চিন্তা এখন মৌমাছির সেই গোলা ঘরের সন্ধান পেলেই হয়। যখন  তীরে পৌঁছলাম,তখন ভাটার টান শুরু হয়েছে নদীর জলে। স্হির রূপোলি রাংতার মত জল কেটে নৌকা থামল নদীর কিনারায়,থকথকে কাদায় ;সূতো কাটা ঘুড়ির মত গোত্তা খেয়ে ।সাত সকালেই মার্তণ্ড মহাশয় তাঁর অগ্নিকুন্ড জ্বেলে বসে আছেন।সেদ্ধ হতে চলেছে চরাচর। তাতে মহাশয়ের কোন দৃকপাত নেই। আমরাও থোড়াই কেয়ার করে একে একে নামতে লাগলাম প্যাচপ্যাচে পচা কাদায়।যেখানে  সেখানে ঘন হয়ে উদ্ভিদের  শ্বাসমূলগুলো আকাশমুখি হয়ে রয়েছে যেন সৈনিকের বেয়নেট।কাদাখোঁচা পাখির মত লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে সবাই,সর্ব পেছনে আমি আর আমার সহকর্মীরা হাঁটু পর্যন্ত উঁচু গামবুট পায়ে। স্লথ গতিতে যখন স্যাঁত স্যাঁতে ডাঙায় এলাম ততক্ষনে শশধর,আকবর আর তাদের সংগীরা বন-বিবির পূজা শুরু করেছে।

আকবর আলি মৌওয়াল দলনেতা- খাটো,কৃষ্ণকায়,বলিষ্ঠ পুরুষ, তোবড়ানো ডান গাল বরাবর গভীর ক্ষত। বাঘের জোরালো থাবায় ডান চোয়ালের তিনটে দাঁত অস্তিত্ব হারিয়েছে।শুনেছি অনেক জায়গায় দল-নেতা সাজুনি নামে পরিচিত ।মধু সংগ্রহের সময় মউয়ালরা পরস্পরের সাথে কলহ বিবাদ করে না।মিথ্যা কথা সে সময়ের জন্য সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য । মধু সংগ্রহে আকবরের বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতা আর আর্থিক স্বচ্ছলতা তাকে নেতৃত্বে আনুকূল্য  দিয়েছে। তার চক মিলানো বড় টিনের ঘর।ঘরের দরজার কাছে সিঁড়ি বরাবর দুপাশে সন্ধ্যা মালতির ঝোপ , শান্তি আর স্বচ্ছলতার নীড়।তার নিজস্ব নৌকাখানি নিয়ে সে বেরোয় মধু সংগ্রহে। বন বিভাগের মধু সংগ্রহের আর নৌকা নিয়ে বনাঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি পত্র দুটিও  যে তার নামে।শশধর তার  অতি শৈশবের পাঠশালার বিশিষ্ট বন্ধু।শশধরের একান্ত আগ্রহই শশধরকে আকবরের মৌওয়াল বাহিণীতে যুক্ত করেছে।সে মৌওয়াল দলে একেবারে আনকোরা। এই শশধর আর তার বন্ধু আকবরের সহযোগিতাতেই আমি এই মউয়াল দলের সাথে সুন্দরবনে আসতে পেরেছি।সেই যে বলছিলাম ভোঁদড় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি প্রথম শশধরকে দেখি। পরিমিতভাষী,ছ'ফুটি লম্বা,একহারা গড়নের শশধর যেমন মাথায় অনেককেই ছাড়িয়ে যায়,তেমনি তার চরিত্রের আরও অনেক গুনাবলী ওকে আমার  কাছে অনেকের চেয়ে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।ঠিক আমার সামনে সামনে ও হাঁটছিলো,একটু যেন আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার অভিলাষে।ও আমাকে জানিয়েছিলো এই চৈত্র বৈশাখ মাসই মধু সংগ্রহের উপযুক্ত সময় আর এসময় সব মৌওয়ালরা তাদের কাজে ব্যস্ত হে পড়ে।বন-বিবির পূজোর সময় শশধর আমাকে জানাল,হিন্দু বলেন আর মুসলমান বলেন বন-বিবিরে আগে পূজা না দিয়ে জংগলে ঢুকা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।

এসব কি করছ আকবর,তুমি মুসলমান হয়ে পূজা করছ তাও আবার এক নারী মূর্ত্তিকে,আমি বললাম। তড়িৎ জিহ্বা কামড়ে আকবর বলে, ছি ছি একথা শুনলেও পাপ হয় স্যার।সংগে সংগে সে  পরম ভক্তি ভরে পুনরায় বনবিবির উদ্দ্যেশে দু'বার কপালে হাত ছোঁয়াল।বেশ উচ্চস্বরে বলে উঠল,অপরাধ নিও না গো মা।ওরা পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে নিম্নস্বরে কিছু বলাবলি করল আমার অগোচরে। ফটোগ্রাফার রাকিব ফিসফিস করল,স্যার ওরা বোধহয় কোন অশুভ কিছুর আশন্কা করছে।বনবিবিকে তারা 'মা' বলে সম্বোন্ধন করে।সেই মাকে নিয়ে নাকি আমার বিরূপ সমালোচনা!প্রাচীন কাল থেকে,জানা যায়  সুন্দরবনে মনুষ্য পদার্পনের জন্মলগ্ন  হতে  এলাকার অধিবাসীরা  বনবিবিকে নিজেদের রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে মান্য করে।একটি প্রাচীন গল্প মউয়ালদের মুখে মুখে ফিরছে যুগ যুগান্তর হতে। জলিল তার গল্পের ঝাঁপি খুলল ।অভিনব তার গল্প বলার কৌশল,  বিমুগ্দ্ধ  শ্রোতা তার গল্পে চমৎকৃত না হয়ে যাবে না। জলিল বলল সে অনেক অনেক কাল আগের কথা মউয়াল ধনা আর তার ভ্রাতুষ্পুত্র দুখি মধু সংগ্রহে এই গহীন বনে প্রবেশ করেছিলো।সুন্দরী,গর্জন,গরান,কেওড়া,গোলপাতা  আরও বিবিধ নাম জানা, অজানা বৃক্ষ,গুল্ম,লতা,পরগাছায় সুন্দরবন তখন ছিল আরও গহীন।অনেক ঘোরাঘুরি করার পরও যখন তারা মধু না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় দখিনা রায় বা ব্যাঘ্র মশাইর আবির্ভাব ঘটল। ক্রুর দখিনা রায় এক নিষ্ঠুর প্রস্তাব উপস্থাপন করল-জানালো ধনাকে অকল্পনীয় পরিমাণে মধু পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সে করে দেবে কিন্তু পরিবর্তে তার দুখিকে বিসর্জন দিতে হবে।লোভ এমনভাবেই ধনাকে গ্রাস করল যে প্রাণের টুকরো ভ্রাতুষ্পুত্রকে বিসর্জন দিতে সে দ্বিধা করল না।মধু আর মোমে উপচে পড়া নৌকা নিয়ে কিশোর সংগীকে ফেলে সে পলায়নপর হলো।আক্রান্ত দুখি উপায়ন্তর না পেয়ে চীৎকার করে গর্ভধারিণী মাকে ডাকতে লাগল।সেই ডাক শুনে মাতারূপী বন-বিবি তার নিজ ভ্রাতা  শাহ্ জংগলীগে মুগুর হাতে পাঠিয়ে তাকে রক্ষা করলেন।চমৎকৃত হলাম উপকথার চমৎকারিত্বে আর গল্প বলিয়ের কাহিনীর জাল বোনার পটুতায়।আমরা ততক্ষনে বনের বেশ গভীরে প্রবেশ করেছি।সবাই সার বেঁধে হাঁটছি।গা ছমছম করছে।

নাগরিক কোলাহল মুক্ত উষ্ণ আর্দ্র পরিবেশ। শহুরে কোলাহল নেই বটে কিন্তু বনের  বিভিন্ন প্রজাতির পাখির  কল-কাকলি,বানর  প্রজাতির হুপহাপ আওয়াজ,নানা ধরনের রহস্যময় খসখসে শব্দে ভীতির শিহরণ অনুভব করছি শিরদাঁড়া বরাবর।এ বন্য কোলাহল যে কাউকে নিয়ে যেতে সক্ষম অন্য এক ভাব জগতে।ঘামছি আমি,আমরা সবাই। দর দর করে ঘাম পড়ছে সবার শরীর বেয়ে।ভাবতে অবাক লাগে আমি কিনা পৃথিবীর অন্যতম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল সুন্দরবনের অপরূপ,ভীতিকর পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছি। বিশালত্ব যেখানে সৃষ্টির অপার রহস্যে চমকিত করছে অনুক্ষন।বৃহদাকার গাছের গুঁড়িতে অসংখ্য ঝিঁঝিঁ পোকা।বৈজ্ঞানিকি সাময়িকিতে পড়েছিলাম প্রকৃতির  তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে এই পতংগটির প্রতি মিনিটে ডাকের সংখ্যার নাকি একটি প্রত্যক্ষ আনুপাতিক সম্পর্ক আছে।হয়ত বা।কি অদ্ভূত রহস্যময় পৃথিবী! তার কতটুকুই বা জানি।ভাবছি দশ হাজার বর্গকিলোমিটার এই সুবিশাল বনভূমির যা অর্ধেকের বেশী আমার দেশ মাতার অধীন তার কতটুকুই  বা আমরা চিনি,আর কতটুকু পরিচর্যা,রক্ষাই বা করতে পারব।

মউয়ালদের সবার হাতে বড় রামদা' আত্নরক্ষার্থে যা অপরিহার্য।মাঝে মাঝেই এক একজন তারস্বরে চীৎকার করে উঠছে হিংস্র পশুর মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে।আমিনুরের হাতে ক্যানেস্তারাটা কখনও কখনও বেজে উঠছে ঢ্যাঢ্যাং ঢ্যাঢ্যাং  করে।বাঘ ভয় না পেয়ে পারে!বাঘের সংখ্যা অনেক কমে গেছে জানা গেল।আমিনুর রোগা,চশমা চোখে ,মাথায় আধ ময়লা সাদা কিস্তি টুপি,ছাগল দাড়ি নাড়িয়ে সব সময় বিজ্ঞের মত কথা বলে,সে সব কথায় সত্যতা থাক বা নাই থাক। ও হাঁটছে ঠিক শশধরেরর আগে আগে।।থেকে থেকেই  বলিষ্ঠ,নোংরা কামুক চেহারার হালিম বানর হোক,পাখি হোক বা কোন অদৃশ্য বস্তুকে গাল দিয়ে উঠছে অশ্রাব্য ভাষায় ।ওর হাতে মহিষের শিং এর তৈরী এক বিরাট ভেরী,ফুঁ দিলে বিকট ভাবে বেজে ওঠে।।সবার পিছন পিছন আসছে জয়নুল ইসলাম ওরফে জনি সম্পর্কে আকবর আলির ভ্রাতুষ্পুত্র । টিয়া সবুজ রংএর পরিচ্ছন্ন গেন্জী,বুকে কারিনা কাপুরের মুখের ছবি আঁকা।স্মিত হাস্য মুখে মাঝে মাঝে হিন্দি বা বাংলা চলতি গানের দু'এক কলি গেয়ে উঠছে।অস্থির চিত্ত তাকে অস্থির করে রেখেছে- হাঁটার সাথে সাথে তার হাতের দা' গাছ,লতা,গুল্ম নিদেন পক্ষে বাতাসকে কাটছে।

একটা ভ্যাঁপসা,সোঁদা গন্ধ অরণ্যে যে আরণ্যকীয় অনুভূতি এনে দিয়েছে তা অবর্ণনীয়! সভয়ে বার বার ইতি উতি চাইছি। দূরে এক ঝলক এক চিত্রা হরিণের অপসৃয়মান দেহ দেখতে পেলাম।'আইছে' বলে আমিনুর  চাপা গলায় সবাইকে সতর্ক করল। তার অর্থ বাঘ  আসে পাশে কোথাও আমাদের নিকটবর্তী হয়েছে।আমিনুরের ক্যানেস্তারা বেজে উঠল সরবে।সবাই সতর্ক।বুঝলাম বাঘ পিছু নিয়েছে। হালিমের হাতের মহিষের শিংএ তৈরী ভেরীও বেজে উঠল একবার।ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারব তো! শশধর ঘনিষ্ঠ হয়ে এল আমাদিকে সাহস যোগাতে।এদের চীৎকার চেঁচামেচি আর ক্যানেস্তারার বিকট শব্দের সাথে বাঘের গায়ের তীব্র বোঁটকা গন্ধ ক্রমশ হাল্কা হয়ে এল ।আমাদের সবার মাথার পেছনে বড় বড় চোখ দেওয়া মুখোস, বাঘকে ধোঁকা দেওয়ার কায়দা।ওরা বলল আপাতত বাঘ দূরে সরেছে তবে এটা সাময়িক ব্যাপার ,সতর্ক থাকতে হবে।

নাম না জানা ফুলের মন মাতোয়ারা মিষ্টি হাল্কা একটা সুবাস যেন আচ্ছন্ন করে  ফেলছিলো।জিঞ্গাসায় জানলাম  গরান,পসর,ধুন্দল,কেওড়া আর খালসীর গত যৌবনা ফুলের মিশ্রিত সুগন্ধি এটি।বসন্তে পুষ্পভারে  সমৃদ্ধ বৃক্ষ শাখাগুলোয় মৌ-পিয়াসী মৌমাছির আনাগোনা শুরু হয়।ওরা বাসা বানানো শুরু করে ডালে ডালে।এক একটা চাকে একজন স্ত্রী মৌমাছি,আর পুরুষসহ অসংখ্য শ্রমিক মৌমাছি থাকে।স্ত্রী মৌমাছি প্রকৃত অর্থে একজন রাণী। সর্বোতোকৃষ্ট খাদ্য  ভক্ষন আর ডিম প্রসব ছাড়া তার কোন কাজ নেই।শশধর বলল পসর আর গরানের ঈষৎ লালচে মধু আর নাকি কম সুবাসী আর তাড়াতাড়ি দানা ধরে যায়।ওদিকে আবার খালসী আর কেওড়ার সাদা ফুলের মধু হাল্কা সোনালি আর সুগন্ধিতে ভরপুর।কত কিছুই না জানতে পারছি।মন ফিরে এল মৌমাছির জীবন ব্যবস্থায়।প্রকৃত রাণী(রাজ)তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। শ্রমিক মৌমাছি সেখানে ক্রীতদাস।কিন্তু কি সুশৃন্খলিত ভাবে সব নিয়ন্ত্রিত।শশধর ব্যক্ত করল সেরকম অনুকূল অবস্থায় নাকি এক একটা চাক থেকে বিশ কিলো পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়।আমিনুর ছাগল দাড়ি নাড়িয়ে সরব হলো,আমি একবার আশি কিলো মধু পাইছিলাম।বলার সময় তার গলার স্বর হঠাৎ যেন একটু খাদে নেমে গেল।তবুও তা আকবরের কানে গেলে আকবর ব্যঞ্গ করে বলে ওঠে,কোন্ বছর রে আইনু? মিছা একটু কম ক।তুই তো সব সময় আমার সাথেই! আমিনুরের প্রতুল মধু প্রাপ্তির কথায় মনে পড়ল এপিস ডরসাটা প্রজাতির মৌমাছির বিশাল চাক থেকে এ পরিমান মধু পাওয়া যায়।সবাই বেশ নীচু স্বরেই কথা বলছিলো,এটাই এখানকার নিয়ম।

হঠাৎ শশধর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে,হাত প্রসারিত করে এবং আমার চলার গতি রোধ করে।তার দৃষ্টি অনুসরণে  হিলহিল করে একটা চকচকে কালো সাপকে পাশের ফার্ণ-ঝোপ থেকে বেরিয়ে চলে যেতে দেখি অদূরে বাসক ঝোপের আড়ালে, উপরে যার ঝুলন্ত মাধবী লতার প্রস্ফুটিত সতেজ বল্লরি।।হালিম তার স্বভাব মতো সাপটার সাথে নিজের অনৈতিক  যৌন সম্পর্ক জড়িয়ে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করে ওঠে।স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা মাটিতে রকমারি কীটপতজ্ঞ;ঝোপ- ঝাড়ে অসংখ্য নানা আকারেের নানা রংএর মাকড়সা নিরলস ভাবে জাল বুনে চলেছে।ঘন অরণ্যের বাহারি পত্রদল এমনই গায়ে গায়ে সন্নিবেশিত যে ঊর্ধে  নীলাম্বরের উদার দৃশ্যপট ছিন্ন ভিন্ন।পাতার ফাঁকে ফাঁকে আসা হলদে রোদ মাটিতে  কিছু আলো ছায়ার  দূর্বল আলপনা এঁকেছে ।দলের সবার দৃষ্টি গাছের উুঁচু ডালে মৌচাকের সন্ধানে।ইতিমধ্যে সবাই বনের বেশ গভীরে চলে এসেছি।বাঘ বাবাজির উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে।খুব
অস্বাভাবিক ভাবে অরন্যে একেবারে প্রবেশের সাথে সাথে মামা আমাদের পিছু নিয়েছে।মউয়ালরা একটু শশব্যস্ত।সবার মন কূ গাইছে। এমন তো কখনই ঘটেনি।আকবর তো সবাইকে জিঞ্জাসা করেই বসল,এই তোমরা সবাই বউ,ঝিদের মাথায় তেল-সাবান না দিতে কয়া আসছ তো?শশ তোমার পিসী তো আবার মরিচ না পুড়্যা ভাত খায় না,দলনেতা বলে।না !না !পিসী আগেই মরিচ পুড়্যা বোতলে ভরে রাখছে,শশধর জানায়।ওদের বউ ঝিরা এ কটা দিন ভেজা কাপড়ও নিংড়াবে না । পরিবারের পুরুষদের নিরাপত্তা ও মংগল কামনায় এ আচার অনুষ্ঠান গুলো মউয়াল পরিবারের মেয়েরা খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করে।একটু মানসিক দ্বন্দে পড়লাম,মউয়ালরা ভাবছে কিনা বন-বিবিকে নিয়ে আমার উক্তি বনবিবিকে কুপিত করেছে। ওরা বারবার উচ্চারণ করছে!কখনও তো যাত্রার শুরু থেকেই ওরা বাঘের উপস্থিতি অনুভব করে না।

জয়নুল ওরফে জনি চাপাস্বরে বলে ওঠে,কাকা ঐ উই যে  উইই।সবাই চাপা স্বরে জানতে চায় কই? কই?।ঐ যে হাতের ডান দিকে উরপে তাকান।জনি উপরকে 'উরপে' বলেই উচ্চারণ করে গোড়া থেকেই লক্ষ্য করছি।সবাই সসব্যস্ত হয়ে উঠল। নজরে পড়ল বেশ বড় -সড় একটা মৌচাক।দলের ভেতর একটা আলোড়ন উঠল।জনি ঘ্যাস ঘ্যাস করে কিছু শুকনো আর সতেজ  ঝোপ-ঝাড়ের শাখা প্রশাখা কেটে ফেলল।শুকনো ডালপালা গুলোকে সবুজ ডালপালাহাঁটছে দিয়ে বেশ করে মুড়িয়ে লতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধল।ততক্ষনে হালিম হাতে ধারাল দা নিয়ে গাছে ওঠার জন্য প্রস্তুত।সবাই জামার হাতা নামিয়ে ফেলে,শুধু চোখ বাদ দিয়ে মাথা-মুখ গামছা দিয়ে জড়িয়ে নিল।আমরাও আমাদের মুখ, মাথা ঢেকে ফেললাম।হালিমের ভেরী এখন শশধরের হাতে।আমিনুর হাতে বড় একটা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি নিয়ে চাক বরাবর  একটু নীচের একটা ডালে বসল।তর তর করে গাছে উঠে পড়ল হালিম,পকেট থেকে লাইটার বের করে শুকনো ডালপালায় আগুন ধরিয়ে দিল।নীচে বাকি মউয়ালরা সদা সতর্ক,বিশেষ করে বাঘ পিছু নিয়েছে।ধোঁয়ায় আক্রান্ত মৌমাছি ভন ভন করে উড়তে রইল।ক্ষীপ্র হাতে হালিম টুকরো টুকরো করে মৌচাক কেটে কেটে নীচে হাঁড়িতে ফেলতে লাগল।সাথে সাথে  পড়তে থাকল সোনালী রংএর মধু টুপুস টুপুস করে।প্রচুর মধু!প্রাপ্তির আনন্দে মউয়ালদের চোখ চকচক করছে।আমিও আনন্দিত এই ভেবে হয়ত অচিন্তনীয় পরিমান প্রাপ্তি বনবিবি সম্বন্ধে আমার মন্তব্যে ওদের বিরূপ ধারনার অবসান ঘটাবে।রাকিব ক্যামেরায়  মউয়ালদের সমূদয় কার্য কলাপের ছবি বন্দী করায় তৎপর রইল।রমেশ বিভিন্ন বিষয়ের উপর কিছু তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত।

বেশ নির্বিঘ্নেই মধু আর মোম সংগ্রহ হলো।এবার ফেরার পালা।আমরা আবার সেই আগের মত এক সারিতে হাঁটছি।হালিমের মাথায় মধুর হাঁড়ি,সে চলেছে সবার আগে।ঠিক তার পেছনেই  পরমানন্দিত আকবর হাঁটছে সদৃপ্ত ভংগীমায়।পেছনে ফেলে যাচ্ছি  বিশাল ক্যানভাসে আঁকা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের শ্রেষ্ঠতম শিল্পীর অপূর্ব ব্যন্জনাময় এক বর্ণিল ছবি 'সুন্দরবন'  যার পরিচয়।

প্রায় নদী কিনারে পৌঁছে গেছি।পশ্চিম আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা।বৈশাখী মেয়ে তার রুদ্ররূপে আগত প্রায়।বেতস ঝোপে এক জোড়া যুধ্যমান গিরগিটি দেখে রাকিব ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমিও একটু থমকালাম।আমার সাথে সাথে রমেশ আর শশধরও থেমে গেল।রাকিব ক্ষীপ্র হাতে সে গুলোর ছবি ক্যামেরা বন্দী করতে লাগল।ইতিমধ্যে আকবর সহ  দলের বাকি সব মউয়াল সবে মাত্র নৌকায় উঠে থিতু হয়েছে।যুগপৎ আমার আর শশধরের দৃষ্টি গেল ঝোপের আড়ালে ভয়াল  বিশলাকৃতি এক বাঘের দিকে।আমি তো স্থাণূবৎ,রমেশ আর রাকিব তন্ময় তাদের কাজে।মাটির সাথে আমার পা-জোড়া যেন কে গজাল দিয়ে গেঁথে দিয়েছে।সমস্ত শরীর আমার অবশ।শশধর এক ঝটকায় মাটিতে ঝোপের আড়ালে  আমাকে ফেলে দিয়ে ভয়ংকর এক হুন্কার দিয়ে উঠল।আমার ধাক্কায় রমেশ আর রাকিবও চীৎপটাং। ভীষণ দর্শন বাঘের সমস্ত শক্তি নিয়ে শশধরের উপর ঝাঁপিয়ে তাকে আক্রান্ত করার চেষ্টা  সাহসী শশধরের রাম-দা এর আঘাতের কারনে প্রথম দফায় ব্যর্থ হল। বীর বিক্রমে শার্দূল যখন দ্বিতীয় বার ঝাঁপিয়ে পড়ার পাঁয়তারা করছে ঠিক তখনই বাকি সব মউয়ালেরা রাম-দা নিয়ে হারে-রে-রে করে তেড়ে এল,ক্যানস্তারা আর ভেরী বেজে উঠল।লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া ব্যাঘ্র মশায়ের আর কোন উপায় থাকল না।মামার আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত হাত নিয়ে শশধর উঠে দাঁড়াল।আমরা নৌকায় ফিরলাম।দলনেতা আকবর পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার ধূলি ধূসরিত পরিচ্ছদ ঝেড়ে দিতে থাকল।সে বলল,স্যার এ যাত্রায় আমরা রক্ষা পাইলাম। বন-বিবি বাঁচায়ে দিল।উনার সম্বন্ধে কিছু বলা ঠিক না।

বেওকুফ আমি! দুঃখ প্রকাশ করলাম দল-নেতার কাছে ,দলের কাছে।বললাম আমি খুব দুঃখিত। ওরা সবাই সমস্বরে বলে উঠল, সমস্যা নাই স্যার,বন-বিবি ক্ষমা করে দিছে।নাইলে আজকে প্রাণ নিয়ে নৌকায় ফিরতে হত না।ওরা কত ভদ্র।আমার দুঃখ প্রকাশের জবাব দিল ভদ্র ভাষায়,আমাকে দিল একটু স্বস্তি। কিন্তু ওদের মন থেকে বনবিবিকে নিয়ে আমার ব্যঞ্গই যে শার্দূল আক্রমনের কারণ তাতো মুছে যায়নি।মনে হল  আমার এই আঁতলামি টুকুর তো কোন দরকার ছিল না।সহস্র সহস্র বছর হতে যে বিশ্বাস নিয়ে এ অঞ্চলের লোকেরা জীবন কাটাচ্ছে তাতে আমার অবিশ্বাসের কথাটুকু তুলে কি সুরাহা হল। বিশ্বাসই হোক বা কুসংস্কারই হোক;এতে কি বা ক্ষতি হচ্ছে জগতের। বরং এই আচার  থেকে তারা দূর্জয় সাহস, প্রচন্ড শক্তি,আর আত্নবিশ্বাস অর্জন করে যা কিনা তাদের এই বিপদ সংকুল জীবনের হয় পরম পাথেয়।আধুনিক,সভ্য সমাজে এমন তো কতই ভুবন বিখ্যাত অভিযাত্রি, শিকারি  এমনকি গবেষক আছেন বা ছিলেন যাঁদের অদ্ভুত সব বিশ্বাস,সংস্কার আছে বা ছিল।খ্যাতনামা শিকারী জিম করবেট বিশ্বাস করতেন যতক্ষন না তিনি একটি সাপ মারতে পারছেন ততক্ষন তিনি কোন শার্দূলের দেখা পাবেন না।আবার মাছ শিকারী জক্ ডুগে কখনই গভীর সমুদ্রে যাওয়ার সময় কলা বা কলা মিশ্রিত কোন খাবার জাহাজে তুলতে দিতেন না
এসব অল্প বিস্তর কুসংস্কার চর্চায় কি আসে যায়!

আমার নৌকায় 'প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স' ছিল।তুলো আর জীবাণুনাশক বের করে শশধরের ক্ষতগুলো পরিষ্কার করা হলো। ওকে আবারও ডাক্তারের স্মরণাপন্ন  হতে হবে।দুটো নৌকাই চলা শুরু করেছে।জনি ভরাট  গলায় গান ধরল....বিস্তীর্ণ দু'পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার.....ও গঞ্গা বইছ কেন।

Friday 26 August 2016

দুটি প্রাণ দুটি পাতাবাহার

প্রায় দু'যুগ আগের পটভূমিকায় কবে যেন কি সব হযবরল লিখেছিলাম,নিম্ন শ্রেণীর শিশুর হাতের লেখা চর্চা করার দাগটানা খাতায়।কাগজগুলো যে খুব মলিন,বিবর্ণ,প্রাচীন হয়ে গেছে জীবন ও ব্যক্তির মত তা নয়।বেশ ঝকঝকেই  আছে।তো খেয়াল হল রাখি না এগুলোকে একটু গুছিয়ে একজোড়া দম্পতির ভগ্ন হৃদয়ের প্রমান স্বরূপ।সেই ষাট দশকের এক কাহিণী।
মনে করা যাক  জমিলা আর আক্কাস সেই ক্ষরিত হৃদয়ের একজোড়া দম্পতি।বহু দিন পর জমিলার নিরানন্দ জীবন আনন্দে যেন ঝলমল করছে এত রোশনাই,কোথায় ছিল মুখ লুকিয়ে ভাবে জমিলা।জমিলার জীবন পাত্রে আনন্দ উপচান শুধু বাকি। সতত বহমান  নদীর মতো জমিলা আর আক্কাস আলি  যেন অনবরত আনন্দে ছলছল  কলকল করছে।জীবনের আনন্দ-উল্লাস,উদ্দেশ্য,আশা ভরসা সবই যে কোথায় হয়েছিলো নির্বাসিত!ম্রিয়মান জমিলা হাসতে  ভুলে গিয়েছিল দীর্ঘ দিন হতে।জীবন যে এত সুন্দর,এত বর্ণাঢ্য এত ভুলেই  গিয়েছিলো জমিলা,রূপসী জমিলা।


শুধু কি জমিলা আক্কাসও তো উদাসিন হয়ে পড়েছিলো জীবন নির্বাহে।চর্তুপার্শ্বের সবুজ গুল্ম-লতা,বর্ণালি পুষ্পগুচ্ছ ওদের মনে দোলা দিতে ভুলে গিয়েছিলো।আজ সব দৃশ্যাবলী ওদের চোখে বড় রমনীয়,বড় আনন্দময় বড়ই অর্থবহ হয়ে ওঠে।
জমিলা বলে,নতুন শাড়ীটা পরেছি
আক্কাস বলে, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে,না সত্যি বলছি,লজ্জা পেও না
-রং না উঠলেই হয়,
-দোকানী তো কিরে কেটে অত করে বলল একটু নাকি কষও যাবে না
-সে হলেই হয়
-আচ্ছা শাড়ীর রংটা কি  বল তো,দোকানি কি যেন বলল
-আমার মা বলত রাণি রং।সন্ধ্যা মালতি ফুলের রংএ রং
-তোমাকেও তো রাণির মতই দেখাচ্ছে
-এই বয়সে এত চড়া রং
- চড়া রং ব্যবহার করার মতো কিছু কি ঘটেনি
জমিলা যেন একটু লজ্জা পেয়ে মুখটা আড়াল করে দাঁড়াল।
সুন্দরী জমিলার বেশভূষায় কত পরিবর্তন।তার অংগে উঠেছে নতুন শাড়ী,নতুন ব্লাউজ।আক্কাস আলী নিজের জন্যও কিনেছে নতুন কাপড়।কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবন তাদের।আনন্দ-উল্লাস,আশা- ভরসা বিলুপ্ত হলে জীবনের আর অবশিষ্ট থাকে কি?আশ-পাশের বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-পরিজনের দিকে চেয়ে জমিলার মনে হত এত দূর্ভাগী ও।

স্বামী আক্কাস আলীও অতি আনন্দিত।সরকারি অফিসের ছোট পদাধিকারী আক্কাসের  ইদানিং সময়ের কাজের গতিতে বস্ পর্যন্ত চোখ তুলে তাকান।ভাবেন কোন  সে  যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আক্কাস আলী আজ এত চটপটে,মনোযোগী হয়ে উঠল।তারদিকে তাকিয়ে বলেন,বাহ্  কাজটা খুব চটপট করে ফেলছেন তো
-দোয়া করবেন স্যার
-তাহলে কালকের ঐ টেলিফোন ডিপার্টমেন্টের  কাজটুকুও তাড়াতাড়ি করে ফেলুন
-কালই  হয়ে যাবে স্যার
-সেকি,এত তাড়াতাড়ি,দেখবেন ভুল -ত্রুটি যেন না  থাকে।
-না স্যার ভুল থাকবে না

আক্কাস সরকারি অফিসের স্বল্প বেতনভুক চাকুরে।আর জমিলা গৃহিণি,গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ছিলো তাও আবার গড়িয়ে গড়িয়ে।ক্রমশ  সংসারের দৈনন্দিন জীবনের পেষণে হারিয়ে ফেলেছিলো তাল, লয়, সুর,ছন্দ।
আক্কাস মাঝে মাঝেই বাজার থেকে নিয়ে আসে ফলটা-মূলোটা।ফল-মূলে শরীরে রক্ত বাড়ে।জীবনের ব্যাপ্তিতে যা অতি প্রয়োজনীয়।নতুন খবরে
জমিলার মা মেয়েকে দেখতে এসেছিলো, সাভারের এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম থেকে।সাভারের সে গ্রাম থেকে রিক্সায় নদী ঘাটে।নদী পেরিয়ে আবার বাসে ঘন্টা খানেকের পথ।মা বুড়ো মানুষ তাও  মেয়েকে দেখতে এসেছে।মা নির্ণিমেষে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে চালসে ধরা চোখে।তাকে ছূঁয়ে ছূঁয়ে দেখে।সমস্ত শরীর মায় পেট, বুক স্পর্শ করে যেন আগমনের সারবত্তা অনুধাবনে লিপ্ত হয় কাঁপা কাঁপা ,শীর্ণ,জরাগ্রস্ত আংগুল।মা বলে,খাওয়া-দাওয়া করিস না নাকি।
খাই তো
-তাহলে
-তাহলে,এমন ক্যান
 -কেমন ক্যান
-সামছুনের সাথে দেখা করেছিলি
-জ্বি
-কি বলে
-বলেছে ভালই তো ,তবে আবার যেতে
-গিয়েছিলি
-না,কি দরকার
 মা-আট সন্তানের মা জমিলা জননী অভিজ্ঞতা  সমৃদ্ধ।তাঁর কত নাতি-নাতনি ।তাঁর তীক্ষ্ন প্রশ্ন বানে জমিলার নাভিমূল পর্যন্ত  কেঁপে ওঠে।তবে কি?
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ঘড়ির ছোট কাঁটা উধঃ অবস্থান থেকে খানিক ডানে হেললে জমিলার মা খাইরুন্নেসা বাড়ী যাওয়ার প্রস্তুতি নেন।ব্যাগে পানের বাটাটা ঢুকাতে গেলে জমিলা বলে,মা ওই লাল চকচকা জিনিসটা কি গো।মা ঝটিতি ব্যাগ বন্ধ করে রূঢ় হন, কিচ্ছু না,নিজের কাজে মন দাও।আমার ব্যাগ ধরবে না।মায়ের এ হেন আচরনে জমিলা ওরফে জমু স্তন্ভিত হয়।আর মা খাইরুন বৃদ্ধ বয়সে নিজ অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষনে আশংকিত হয়ে পড়েন।যাত্রার ধকল আর সন্দেহের দোলাচলে তিনি পরিশ্রান্ত। তবে উনার মনের কু জিজ্ঞাসা মিটাতে উনি এখনই ধর্ণা দিবেন পীর সাহেবের কাছে,যদিও জমিলা তা জানেনা।এখনই যাওয়া দরকার,হাতে সময় নাই।  আর জমিলাও কি মায়ের আকস্মিক মানসিক পরিবর্তনে হতবাক নয়।

মায়ের এই  নাটকীয় অন্তর্ধানের মন আলোড়িত জিজ্ঞাসা , সব স্তিমিত হয়ে গিয়ে জমিলা আবার নতুন উদ্যমে দৈনন্দিন কাজে লিপ্ত হয়।ইদানিং কালের নতুন রপ্ত করা অভ্যাসমত সামান্য নাস্তা সাজিয়ে স্বামীর সামনে পরিবেশন কে।নিজের প্রতিও জমিলা এখন মনোযোগি।পরিপাটি করে শাড়ী পরে,হাতের চুড়ি কটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে লাল,নীল,সবুজ।জীবনটা তো এখন এমনই রংগীন জমিলা আর আক্কাসের কাছে।ধূসর মরূভূমিতে যে সবুজ প্রানের ইশারা।

প্রতি সন্ধ্যায় আক্কাস আর জমিলা হাঁটে ঘরের সামনের রাস্তা টুকুতে।উৎফুল্ল আক্কাস স্ত্রীকে বলেন,আস্তে হাঁট পড়ে যাবে যে অন্ধকার রাস্তা।জমিলা সন্তর্পনে হাঁটে আর হাসে।ঝুলন্ত কাস্তে চাঁদের দিকে চেয়ে আক্কাস বলেন,আল্লাহ মেহেরবাণ।জমিলাও বলে হ্যাঁ,আল্লাহ মেহেরবান।

বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-পরিজন বাসায় আসে।পান-শুপারি খায়,মস্করা করে। পঁয়ত্রিশর্ধো জমিলার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়ার সৌন্দর্য আক্কাস বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে।ঘনিষ্ঠরা পিঠে পাকালি ,লাল শাড়ী আনতে ভোলে না।মনে কিনতু খচখচে একটা ভাব থেকেই যায়।মা আক্কাসকে বলে গেল গোপনে তার মন নাকি কু গাইছে।আক্কাস ভাবে কেন সে তো অভিজ্ঞ পরামর্শ নিয়েছে।ভুল কোথায়।

তারপর?তারপর আরও অনেকগুলো দিন কাটে, মাস কাটে।কিন্তু আরাধ্য দিনটিতো আর আসে না।অনুভূতি শক্তি কি লোপ পেল।প্রাণের স্পন্দন  তো টের  পাওয়া যায় না কিংবা--আর কোন লক্ষন?

অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও কোন স্পন্দনের অনুভূতি না পেয়ে  ওরা গেলেন চিকিৎসকের কাছে।অভিজ্ঞ চিকিৎসক জানালেন জমিলার জরায়ুতে বাসা বেঁধেছে টিউমার যা ধীর গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা শীঘ্রই অপসারন করা উচিৎ।জমিলা,আক্কাস একসংগে ডাক্তারকে জানায়  পূর্বের মূত্র পরীক্ষার ফলাফলের কথা।চিকিৎসক জানান জমিলা অন্তসত্বা নন।যুগপৎভাবে তার জরায়ুর টিউমার এবং সন্তান চাওয়ার তীব্র আকাংখা থেকে  সৃষ্ট হরমোনের ভারসাম্য হীনতায় শরীরে দেখা দিয়েছে অন্তসত্ত্বা নারীর লক্ষন।চিকিৎসাভাষায় যাকে বলে ফলস প্রেগন্যান্সী। আর প্রথম বারের মূত্র পরীক্ষায়ও কোন ভুল ছিলো।নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকলে এ রকমটি ঘটত না।

সুবেশা-সুবেশী আক্কাস্ আর জমিলা বাড়ী ফিরলেন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।ওদের নিজেদের মনে হলো ওরা যেন দুটি পুষ্প বিহীন পাতাবাহার যা কখনই হয় না ফলবতী।


Friday 12 August 2016

সখি ভালবাসা কারে কয়

আমরা ক'জন একসাথে বসে গল্প করছিলাম তখন গমগমে ভরাট কন্ঠে  হঠাৎ সোহেল গেয়ে ওঠে,'সখি ভালবাসা কারে কয়'।রবীন্দ্র সংগীতের প্রথম কলিটা সবে ঠোঁটে তুলে নিয়েছে বড় গভীর আবেগে আর ঠিক তখনই মুখ ঝামটা দিয়ে মুখরা কাকলি বলে ওঠে,এ্যাই,থাম্ তো।ভালবাসার তুই কি বুঝিস রে,দেখিস তো কতকগুলো হিন্দি আর বাংলা বস্তা পচা সিনেমা আর গিলিস তো কতকগুলো বটতলার উপন্যাস।থাম এবার।

সোহেল খিঁচিয়ে ওঠে,'ম্যালা ফ্যাঁচফ্যাচঁ করিস না।দু'দিনের বৈরাগী ভাতকে বলে অন্ন।ভারী দু'কলম শীর্ষেন্দু,রবীন্দ্রনাথ আর কি সব পড়ে এক্কেবারে পাকামো হচ্ছে।

আঁতেল হিমাদ্রি বলে,শোন্,তোরা খামোকাই  ফ্যাসাদ করিস না।বেশ জম্পেশ করে বোস্,বলি তোদের ভালবাসা কাকে বলে।আঁতেল হিমাদ্রির কথা ওরা বন্ধুরা কখনই হেলাফেলা করে না।

হিমাদ্রি শুরু করে,'সেবার গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি যাচ্ছি।'সুপার' পরিবহনের বাস্।প্রচন্ড গরম। ঊর্ধ্ব গগনে  মার্তন্ড মহাশয় একেবারে রেগেমেগে ফর্টি- নাইন।বাসের যাত্রীরা সব ঘেমে নেয়ে উঠেছে যেন।গরমে আর ঘামের গন্ধে বাসের পরিবেশ হয়েছে নরক।বাসে আমার পাশের জোড়া আসনটিতে বসেছেন এক প্রৌঢ় আর তার প্রৌঢ়া স্ত্রী।স্বামীটি বসেছেন জানালা ঘেঁষে।ঘুম কাতুরে মহিলা বাসে উঠেই আসনের পেছনটায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।সে কি যে সে ঘুম!একেবারে কুন্ভকর্নের ঘুম।জানালা গলিয়ে রোদ এসে গা পুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে কিন্ত্তু মহিলার কোন বোধ নেই।আশ্চর্য হলাম,পুলকিত হলাম,আবেশে মাথা নত হলো পুরোটা সময় ভদ্রলোক জানালার  দিকে পিঠ দিয়ে রোদ ঠেকালেন।স্ত্রী ঘুমিয়ে রইলেন ভালবাসার শীতল ছায়ায়!

রওনক ওদের সবার চাইতে একটু ভারিক্কি ধরণের।বলল, 'থাম থাম তোরা
তো শুধু ভালবাসার একটা দিকই দেখেছিস।গত শীতে গেছি পিকনিকে আমাদের পাড়া থেকে।কেউ কেউ আবার নিজ নিজ বন্ধু-বান্ধব কেও আমন্ত্রন জানিয়েছে।পরিচয় ও কুশল বিনিময় পর্ব চলছে চেনা অচেনাদের মধ্যে।এক ভদ্রলোক এসেছেন তাঁর ষোড়শী কন্যাকে নিয়ে।পরিচয় আদান-প্রদানের পর্বে ভদ্রলোক পরিচয় দিচ্ছেন নিজের ও কন্যার।কন্যার দিকে তিনি আবেগ আপ্লুত দৃষ্টিতে তাকালেন। চোখ দুটো তাঁর ভালোবাসা আর গর্বে মাখামাাখিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।কোন এক আলো যে ধ্রুপদী  নাচ নেচে গেল তাঁর চোখ দুটোয়।আলাপের ফাঁকে চোখ থেকে চশমা খুলে কন্যার ওড়নার প্রান্তে মুছে নিলেন।আমি প্রত্যক্ষ করলাম এক স্বর্গীয় প্রেম পিতা ও কন্যার মধ্যে।


শোন আমি শোনাই তোমাদের  ভ্রাতৃ প্রেমের কাহিনী,বলল আহমদ।দু সহোদর।দুজনা দুজনার প্রাণ।বছর পাঁচেকের বয়সের তফাৎ।স্কুল পড়ুয়া ভাই দুটির  কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না। পিতৃহীন ভাই দুটি দরিদ্র মায়ের ছিন্ন আঁচলের আশ্রয়ে তরতর্ করে বেড়ে উঠছে মফস্বলের বস্তিতে।খরো চৈত্র মাসে কি ভাবে যেন আগুন লাগে বস্তিতে।আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে পুরো বস্তি।দুঃখি মা কোথায় গিয়েছিলো কাজে ।বড় ভাইটি সামনে দোকানে ফুট -ফরমাস খাটছিলো।আগুন দেখে এক ছুটে ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত ছোটভাইকে বুকে জাপটে বেরিয়ে এল বটে কিন্তু ততক্ষনে নির্দয় আগুন তাকে গ্রাস করেছে।

আমি বললাম,আমি তোদের আর এক কাহিনী শোনাই।গ্রাম্য সালিসি ও সমাজের অত্যাচার এবং জটিল মনস্তত্বের কাহিণি।মানুষের মনের নাগাল পাওয়া ভাই ভারি দুরূহ ব্যাপার।মাস দুয়েকের শিশু সন্তান নিয়ে দরিদ্র  যুবক কৃষক ও কিশোরি কৃষাণীর সুখের সংসার।কথায় বলে না রাগ হলো চন্ডাল।তুচ্ছ কারণে সেই চন্ডাল পেয়ে বসল কৃষককে।কৃষক রাগে কাঁপতে কাঁপতে চীৎকার করে কৃষাণীকে দিয়ে দিল তালাক।আর যায় কোথায়।পাড়ার
লোকজন,মাতবর সেই তালাক কার্যকর করায় এক কাপড়ে শিশুপুত্র সহ স্ত্রী গৃহত্যাগ করল।সবাই হৈ হৈ করে উঠলো,'এ্যাই ভিন্ন প্রসংগে যাচ্ছ কেন?আমি বললাম,না প্রসংগ পাল্টাইনি ধৈর্য ধর।তারপর এই যুবক ও কিশোরি তাদের জীবন অতিবাহিত করল  বড়ই কষ্টে,সংগীবিহিন।আমার বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে,তুই এত কথা জানলি কি ভাবে। আরে্ ঐ  প্রৌঢ়ত্বের শেষ কোঠায় পৌঁছানো মহিলা তখন আমাদের ঘরে ঠিকা কাজ করত যে।একসময় মহিলার স্বামী ও যুবক ছেলে শহরে এসে হাজির।মহিলা পরম মমতায় শাক-ভাত,পাতে একখানি কাঁচামরিচ সাজিয়ে বুড়োর সামনে সাজিয়ে ঘোমটায় মুখ ঢেকে খানিকটা দূরে বসে থাকত।লোকটি যে পরপুরুষ,তার স্বামী নয়। কখনও নিজে অভুক্ত থেকেও বুড়োকে খাওয়াত। প্রশ্ন করলে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বলত,'সবই অদেষ্ট'। সবাই বিষণ্ণতায় খানিক চুপ কর থাকল।

একসময় নীরবতা ভংগ করে হায়দার বলে,তবে শোন তোরা আমার আপন খালা খালুর গল্প।আমার মায়ের আপন বোন লীজা খালা,মায়ের ছ' বছরের ছোট।খালা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং পড়াতেন।তো লেখাপড়া করতে করতেই তিনি প্রেমে পড়লেন।পড়বি তো পড়্ একেবারে ঘাড় মাথা মুড়িয়েই পড়লেন।প্রেমে পড়লেন আমাদের খালুর সাথেই।তো সে প্রেম এক অনবদ্য কৈশোর প্রেম।খালা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থি আর খালু উচ্চ মাধ্যমিক।আট বছরেরও বেশী সময় প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার পর অবশেষে নৌকা ঘাটে ভিড়ল।প্রেমের বিয়ে হলে কি হবে প্রতিদিন মান-অভিমান, ঝগড়া-ঝাঁটি লেগেই থাকত।আবার কি ভাবে যেন মিটমাটও হয়ে যেত।সেই খালা বলা নেই কওয়া নেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন হঠাৎ।হাসপাতাল থেকে মরদেহ যখন বাসায় এল,খালু একবার শুধু তাকিয়ে বললেন,'লিজা তুমি যাও আমি আসছি।তারপর ধীরে সুস্থে বিছানায় গিয়ে শুলেন।মরা বাড়ীতে সবাই ব্যস্ত।তারই এক ফাঁকে খালার বড় মেয়ে খালুকে ডাকতে গিয়ে দেখল খালু নেই-চলে গেছে-খালার কাছে -তার লিজার কাছে।সবার মন ভারাক্রান্ত হল।

কলেজের দুপুরের একঘন্টা বিরতির সময় শেষ হল।সবাই চললাম যে যার ক্লাসে।মনে বেশ অনুরণন চলল খানিক সময় ধরে ভালবাসার বিভিন্ন ঘটনাগুলো নিয়ে।

Saturday 25 June 2016

ভোঁদড় ও একজন শশধর

শৈলবালা খুব ভোরে পূব গগনে সূর্য  উঁকি দেওয়ার আগেই গোলাপি অরুণিমা গায়ে মেখে ভোঁদড় (ধাইরা)গুলো নিয়ে পশ্চিম দিকের ঝোপালো ঢিবিগুলোতে গেছে।ভোরের আবছা আলোয় ওখানে পাওয়া যায় বেশ কিছু কাঁকড়া আর পোকামাকড়--ধাইরার খাদ্য। ভোঁদড়(ধাইরা)গুলোকে নিজেরা না খেয়ে হলেও খাওয়াতে হয়।প্রাণ ভোমরা ভোঁদড়গুলো যে ওদের জীবিকা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার।

ওর স্বামী শশধর বিশ্বাস আজ ক'দিন ধরে বাড়ীতে নেই।বাড়ী শব্দটা মনে,নাকি মাথায় এলে ওর হাসি পায়।এটাও একটা বাড়ী!!বর্ষায় চাল দিয়ে জল পড়ে।পৌষ-মাঘে উত্তুরে ঠান্ডা কনকনে হাওয়া একেবারে হাড়ে কাঁপুনি  ধরিয়ে দেয়।তবে ঘরের চালের ফুটোর কারণে কোজাগরী পূর্ণিমার আলো  ভারী মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে পর্ণ কুটিরে।মনে পড়ে  আশ্বিণে এ বাড়ীতে প্রথম রাতে শশধর ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,বউ চাঁদের আলোয় তোমারে যে কি সুন্দর লাগতেছে।ও মনে মনে না হেসে পারেনি।ওর বাবার ঘর তো দৈন্যতায় এরকম দাঁত ব্যাদান করা হাসি হাসে না।

ভোঁদড়ের সাহায্যে মাছ শিকার ওদের মত অনেক মালো সম্প্রদায়ের আদি পেশা। কয়েক শতাব্দী ধরে ওরা এ পেশার সাথে যুক্ত।শৈলবালার বাবারা জাতে কৈবর্ত। তারা যেমন মাছ ধরত জাল ফেলে আবার যুগপৎ ভাবে জাল ফেলে আর ভোঁদড়ের সহায়তায় তেমনি আবার মহাজনের জমিতেও চাষ-বাসের কাজ-কর্মে নিযুক্তি পেত।শশধর আর ওর বাবাও যে কখনও জমি জিরেতে কাজ করেনি তা নয়।পূর্বে মালো আর কৈবর্তর ভিতর বিয়ের সন্মন্ধ ছিলো অসম্ভব।আজকাল সামাজিক নিয়ম নীতিগুলোয় অনেকটাই শিথিলতা এসেছে।শৈলবালার ছোটবোন গিরিবালারও তো পালটি ঘরে বিয়ে হয়নি।

ভোঁদড়গুলো ততক্ষনে ওদের  ধারাল নখরযুক্ত হাঁসের পায়ের পাতার মত পা দিয়ে হাঁচড় পাঁচড় করে মাটি খুঁড়ে উচ্চিংড়ে বার করে উদরপূর্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।তিন চার কেজি ওজনের হাত খানেক লম্বা ভোঁদড় যখন শিকার ধরার জন্য ছুটাছুটি করে  শৈলবালা তখন রীতিমত হিমসিম খায় ওদের সামলাতে।ঘর্মাক্ত শরীরে ও ভোঁদড়গুলোর গলায় বাঁধা রশিটা টেনে ধরে রাখে।

এতক্ষন শৈলবালা খেয়াল করে নি পশ্চিমের বাঁশ ঝাড়টার গোড়ায় নিকারি সামসুর লম্পট ছেলেটা গলায় লাল একটা মাফলার জড়িয়ে ওর দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।চিন্তার জাল ছিঁড়ে শূণ্যে দৃষ্টি রেখে শৈলবালা স্বগতোক্তি করে,আঃ মরণ আমার!ঝাঁটামারি পোড়ামুখে।নিকারি সামসু নিপাট ভালো মানুষ।শশধরের কাছ থেকে সস্তায় মাছ কিনে নেয় বটে,কিন্তু আর সব ভালো।বিপদে আপদে সুদবিহীন টাকা কর্জ দেয়। বাগানের কলাটা,মূলোটা দেয় কাকিমা মাঝে মধ্যে বিনিপয়সায়।আর এদিকে সামসু কাকার হতচ্ছাড়া ব্যাটা হাড়ে মজ্জায়একটা শয়তান।

শশধর গেছে দলের সাথে সুন্দর বনের গহীন জংগলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাটির চিত্রা নদীতে ভোঁদড়বিহীন মাছ ধরতে । সে এক অন্য পদ্ধতি।পাক্কা দশদিনের ধাক্কা আসা যাওয়ায়।শশধর বলে গেছে,শৈল আমার তো সময় লাগবে। তোমরা সাবধানে থাইক।পোলাটার দিকে খেয়াল রাইখ।কুমির নাকি দেখা যাইতেছে গাঙের ধারে কাছেও।ধাইরা গুলারে ঠিক মত খাইতে দিও।আজ সে ফিরবে প্রায় অপসৃয়মান সূর্য যখন পাটে নামবে তখন।

বড় নৌকায় শশধর,বিমল,রবীন,হাবলু ,রহিম শেখ আর জালালউদ্দিন গেছে।বড় ভারী নৌকা,ওটা সামলে মাছ ধরার কাজ করতে এতগুলো লোকেরই দরকার।নদী যেখানে খাঁড়ি মত হয়ে গেছে,দু'পাশে ঘন সবুজ বন ঝুঁকে পড়ে পরস্পরকে চু্ম্বনের চেষ্টায় ব্যাপৃত ;সেখানে গিয়ে ওরা বাস গাড়ে।সে আর এক গল্প।পরে আাসা যাবে।

ৰেশ কয়েকটা কাঁকড়া যখন খাওয়া হয়ে গেল ভোঁদড়গুলোর, তখন ফিরতে  মনস্থ করল শৈলবালা। নাম ধরে ডাকল ভোঁদড়গুলোকে এ্যাঁকা!ব্যাঁকা! চল্ চল্,অনেক হয়েছে,এবার ঘরে চল্।পুরুষ দুটো ভোঁদরকে ওরা এ নামেই ডাকে।ওদের সর্ব সমেত, পুরুষ আর স্ত্রী মিলে চারটে ভোঁদড়।স্ত্রী ভোঁদড় জিকা এখন গর্ভবতী ক'দিনের ভেতরই বাচ্চা হবে দু'টো কি তিনটে। সব ভোঁদড়েরই গায়ের তেলতেলে ঘন লোম হাল্কা বাদামি রংএর কখনও বা কুচকুচে কালো,গলা আর পেটের দিকটা সাদাটে।স্তন্যপায়ী  জন্তুগুলো শৈলবালার ডাকে বুঝতে পারে ওদের এখন ফিরতে হবে।গলায় বাঁধা রশিতে টান পড়ে। রশিটা বুকের নীচে দিয়ে সামনের দু পায়ের জংঘা সন্ধি বেড় করে গলার সাথে বাঁধা থাকে।তাই ভোঁদড়গুলোকে জেলেরা সামলাতেও পারে আর রশির ঘষায় ওদের গলাও ক্ষত- বিক্ষতহয় না। ওরা এখন ঘরমুখি
  । ওদের তীক্ষ্ন চীৎকারে কান ঝালাপালা  হয়ে যাওয়ার যোগাড়। ঘরের পেছনে স্যাঁতস্যাঁতে  ঘন ঝোপের তলায় জিকা গাছের গুঁড়ির সাথে ওগুলোকে বেঁধে শৈল যাবে নদী পাড়ে।এই জিকা গাছটার তলায়  মাদি ভোঁদড় জিকার জন্ম হয়েছিলো। নদীর জলে একেবারে কিনার ঘেঁষে জল-কলমি আর টোপা পানার ঝাড়ের ভিতর পাতা কুঁড়ো জাল থেকে শৈল  কুচোমাছ যা দু'চারটে পাওয়া যায় তুলে আনবে। ইন্দুমতি -শৈলর পিস-শাশুড়ি তখন দুধ নিয়ে বিলি করতে যাচ্ছে মুসলমান পাড়ায়। সে সেখানে নিকারি সামসু মিঞা আর সাহেদ মাষ্টারের বাড়ীতে কখনও পোয়াখানেক কখনও বা আধসের আন্দাজ দুধ দেয়।কখনও বা পাঁচমিশালি শাক নিয়ে গেলেও দুটো পয়সা জোটে।বিত্তবান সামসু বা সাহেেদের স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা এগুলো খুব পছন্দ করে।

আগামীকাল শশধর বেরুবে ভোঁদড় নিয়ে।অনেকদিন ধরে ওর নৌকাটা একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কাদের আসবে নৌকা নিয়ে নদী পাড়ে।এবার সংগী  হবে মুন্সি, গৌরাঞ্গ আর রন্জন।ওরা স্থির করেছে সন্ধ্যায় যখন আযান দেবে আর শাঁখ বাজবে ওরাও তখন যাত্রা শুরু করবে।সন্ধ্যার পর থেকে মাছ বেশী বেশী পাওয়া যায় কে না জানে!বিকেলে শশধর,গৌরাংগ আর রন্জন পূজো দেবে নদী ঘাটে।প্রতি বারই ওরা পূজো দেয় এবার যাবে চিত্রা নদীর বেশ গভীরে,তাই এবার ঘটা একটু বেশী।কালু রায়ের পূজো।কালু রায় কুমির দেবতা।তাকে সন্তুষ্ট করলে কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এই ওদের পরম বিশ্বাস।

শৈলবালা সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছে। রাংতায় মোড়ানো মাটির ঢাল-তলোয়ার,তীর-ধনুক আর টকটকে লাল পোশাকে মাটির ঠাকুর এখন একেবারে যুদ্ধ দেবতা।কাঁসার থালায় বনঝাউ,মুড়কি আর একটু শুকনো খই এর নৈবদ্য সাজিয়ে শৈলবালা এল বড় অশথ্থ গাছের নীচে বেদীর কাছে।শৈলবালার ছেলে জয়ন্ত বাবার রাতে খাবার জন্য এনেছে চিড়ে,মর্তমান কলা আর বোতলে একটু গাই দুধ।পিসী ইন্দুমতি বড় যত্নের সাথে সব গুছিয়ে দিয়েছে।শশধর আর শৈলবালা নৌকার অপেক্ষায়।শশধর বলল,বউ এভাবে তো আর চলে না।আগে  বাড়ীর ধারেকাছে নদীর কিনারায় মাছ মারতে গেলে কিছু মাছ,কাঁকড়া পাইতাম।এখন যে কি আকাল লাগছে!নিরুপায় শৈল খসখসে, কর্কশ হাতটা চিন্তিত স্বামীর পিঠের উপর রাখে, সহমর্মিতা জানায়।খুব মন খারাপ করলে, বা আনন্দিত হলে এক কথায় আবেগ তাড়িত হলে শশধর শৈলবালাকে 'বউ' বলে সম্বোন্ধন করে।ভোঁদড় গুলোর খাবার জুটাবো কোথা থেকে,মাছই তো ধরা পড়ে  না সে পরিমাণ।নৌকাটাও মেরামত করতে পারি না,পোলাপানরে কি খাওয়াব ,কি পিন্ধাব।দিশা পাইনা বউ।শশধরের অসহায় কথাগুলো আর্তনাদের মত শোনায়।শৈলবালার কপালেও চিন্তার দু'টো তাৎক্ষণিক ভাঁজ পড়ে।দৈন্যতা আর অনিশ্চয়তা ওদের বয়সের তুলনায় অনেক বুড়িয়ে দিয়েছে।


ওদিকে কাদের আর মুন্সি ওদের পাড়ার মসজিদে মিলাদ পড়িয়েছে।সামান্যই আয়োজন, মসজিদে উপস্থিত জনের মাঝে বাতাসা বিতরণ।আয়োজন যাই হোক না কেন প্রার্থনা তো অন্তরের গভীর কন্দর হতে!গত সপ্তায় এক মালো জেলে গেছে কুমিরের উদরে।ওরা সবাই রওয়ানা হবে অতি শীঘ্রই। কাদেরের স্ত্রী জোহরা আর ছোট ছেলেটা এসেছিলো ঘাট পর্যন্ত কাদেরকে বিদায় দিতে।ছেলেটার প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে,পোয়াতি বউটারও পরণে বিবর্ণ, ছিন্নপ্রায় শাড়ী।ছ'ছটা ছেলেপিলের বাপ কাদের ।নাঃ এবার ফিরে এসে ও বন্ধ্যাকরন করাবে, মোল্লাদের কুযুক্তিতে ভুলবে না,ভাবে কাদের। ভগ্নপ্রায় হীনস্বাস্থ্য বউটার দিকে চাওয়া যায় না। ।ওর খাবার এসেছে বাড়ী থেকে। একটুখানি মলা মাছের চচ্চড়ি খূব ঝাল করে রান্না। জোহরা রাঁধে ভালো,যেন অমৃত-- কাদেরের নিজস্ব মূল্যায়ন। মুন্সি সদ্য বউ তালাক দিয়েছে।বৃদ্ধ বাবা স্ত্রীর রান্না করা শুটকি-বেগুনের তরকারি আর মোটা চালের ভাত,এককোণে দু'টো কাঁচামরিচ দিয়ে সাজিয়ে ছোট টিফিন বাটিতে করে এনেছে ছেলে মুন্সির জন্যে।গৌরাংগ আর রন্জনও রাতের খাবার এনেছে বাড়ী থেকে।

ভোঁদড়ের বাক্স তোলা হলো নৌকায়। চার ফালা করে কাটা মোটা বাঁশের ফালি পাশাপাশি বেঁধে বানানো বাক্স,ডালাটা উপর দিকে খোলা যায়।একজোড়া ভোঁদড় শশধরের আর একজোড়া মুন্সির।ভোদড়গুলোকে রাখা হয়েছে এই বাক্সটার ভিতর। শশধরের জিকা নামে ভোঁদড়টা আজ কালের ভিতর বাচ্চা বিয়াবে তাই জোড়াটাকে রেখে আসতে হলো বাড়ীতে। এবারের বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটে খানিক বড় হলেই  আনিসের কাছে  বিক্রি করবে,কড়ার হয়েই রয়েছে। বাচ্চা ভোঁদড়গুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শশধর মাছ ধরা শিখাবে। ভোঁদড় প্রশিক্ষণের কৌশল তো আর সবাই জানেনা ।এ বাবদও বেশ কিছু নগদ আসবে হাতে।

 মাছ বিক্রির টাকা আনুপাতিক হারে বন্টন হবে ওদের সবার মধ্যে। সিংহভাগ পাবে কাদের মিঞা। এর পরের বড় অংশ হবে শশধরের, ও যে মাছ ধরার জাল আর দু'টো ভোঁদড়ের মালিক।সবকিছু তোলা হলো নৌকায়। এক কলসী পানিও নিতে ভুলল না ওরা।শশধর ত্রিকোণাকৃতি জালটার বাঁশের তৈরী একবাহু  ভালো করে বাঁধল লম্বালম্বি করে নৌকার একপাশে।ঐ মুন্সি মজবুত কইরা বাঁধ্ দে।গাযে জোর নাই নাকিরে?শশধর বলে,। বাকি আড়াআড়ি করে বাঁধা দুটো বাঁশের সাথে আটকানো জাল ধরে থাকবে শশধর আর রন্জন।আর  বৈঠায় থাকবে কাদের, ওর নাও  সুতরাং কর্তৃত্ব আর আয়েস তো ওই উপভোগ করবে।লগি নিয়ে দাঁড়াবে মুন্সি।গৌরাংগও থাকবে লগি হাতে।সব কিছু তোলা হলো। লাল সূর্য অস্ত যায় যায়।ওরা সবাই উঠল নৌকায়।শৈলবালা শাঁখ বাজাল,কাদের পশ্চিমমুখো হয়ে আজান দেওয়ার সাথে সাথে ওরা নৌকা ভাসাল নদীতে।
 ভোঁদড় গুলোর চীৎকারে তিষ্ঠানো দায়। খানিক অগ্রসর হওয়ার  পর ওরা ভোঁদড়গুলোকে পেট পুরে খেতে দিল কাঁচা মাছের কাঁটা,কানসা, ফুলকো,লেজ আর ভালো ক'খানা টুকরো।পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে আকাশে, নদীর কাজল কালো জলে চাঁদের ছায়া খানখান হয়ে ভেংগে পড়ছে।কি মোহনীয় রহস্যময়,গা ছম্  ছম্ করা রোমান্চকর,সৌন্দর্যমন্ডিত বেদনা-বিধূর পরিবেশ। দূরে আঁধার নেমে আসা গ্রামগুলোয় মিটিমিটি করে জ্বলছে দু' একটা প্রদীপ।রন্জনের ভরাট গলার মন কেমন করা গানে সবাই উদাস হলো।অবচেতন হৃদয়ের গোপন ভালবাসা,বাস্তব জীবনের প্রেম,স্ত্রী পুত্র কন্যা পরিজনের জন্য মমতা হাহাকার করে উঠল। ওরা অগ্রসর  হচ্ছে ক্রমশ যেন বিভীষিকার দিকে।

মাছ ধরাই ওদের জীবিকা।বিশেষ করে আরও অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের  মৎস্য-জীবির মতই এটি মালোেদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ব্যবসা এবং এটিকে ওরা পূত-পবিত্র  ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করে।সভ্যতার বিবর্তন,জীবনধারণের ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও মান বৃদ্ধি আর শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে আজ পেশার পরিবর্তন হচ্ছে । শশধর,রন্জন,গৌরাংগর মতো নড়াইল, খুলনার অনেক মালো মৎস্য শিকার এবং ভোঁদড় ব্যবহারে উৎসাহ হারাচ্ছে।অনেক মুসলমান জেলে আজ শশধরের  মতই ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করে। এত সমস্যা তবুও শশধরের বর্তমান জীবিকা থেকে সরে আসতে মন চায় না ।সেই কোন্ শৈশব থেকে বাবা-কাকাদের সাথে কালে ভদ্রে ঠাকুরদার সাথেও শশধর ভোঁদড় নিয়ে মাছ ধরতে গেছে।জল,জলজ প্রকৃতি আর মাছের সাথে,মাছ ধরার নিবিড় কৌশলের যে এক মাদকতা ওর রক্তে এবং হাজারো জাত জেলের রক্তে তা তারা এড়িয়ে যাওয়া কি এতই সহজ।কি এক উন্মাদনা হাতছানি দেয় অহরহ।

অনকখানি ভাটির দিকে আগিয়েছে নৌকা।ওরা গলায় রশি বাঁধা ভোঁদড়ের বাক্সের ঢাকনা খোলার সাথে সাথে বোঁটকা গন্ধের ভোঁদড় চারটে বেরিয়ে এলো।ওদের জলে নামিয়ে দিয়ে সবার অপেক্ষা কখন মাছ ধরা পড়বে জালে। প্রশিক্ষিত ভোঁদড়গুলো দ্রুত সাঁতরে,তাড়িয়ে নিয়ে আসে জালের দিকে দিশেহারা মাছের দলকে।উত্তেজিত রন্জন বলে,দাদা কিবা মনে হয়।অন্ধকারে আনন্দোজ্বল শশধরের  চকচকে চোখ না দেখতে না পেলেও ওর ভাষায় যা বোঝার রন্জন বুঝে নেয়।শুধু কি রন্জন আর শশধর, নৌকার সবাই বোঝে আজ ভাগ্য সুপ্রসন্ন।শশধরের ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার অভিঞ্জতা অনক সমৃদ্ধ।তিন বারের জালেই প্রচুর মাছ পাওয়া গেছে।নৌকার পেটের খোলে মাছগুলো খল বল করছে।দুটো মাঝারি আকৃতির চিতল আর পাঁচটা বোয়ালও ধরা পড়েছে,আর ছোট মাছ, সেতো বেশুমার।পূর্ণিমার রাতে মাছও জলকেলি করতে পছন্দ করে শশধর  জানে আর তাই এটি মাছ ধরার উপযুক্ত সময়।

শশধর বলে,কাদের ভাই নাওটা আর এট্টু ভাটির দিকে লন,ওইখানে যেখানে নল-খাগড়ার বড় ঝোপ, ঔখানে তিন চারটা জাল মারব,তারপর আর চিন্তা নাই। খিদা পাইছে কাদের ভাই,আমি দুইটা খায়া নেই।খাওয়ার মাঝখানেই ও চিন্তাপ্লুত হয়।মাথা ঝাঁকিয়ে আপন মনেই ভাবতে থাকে..আসছিলো তো শহর থেকে কত সাহব-সুবো।কত কথা কয়া গেল,ছবি নিল।সুন্দর সব্বড় মাপের কথা কিছু শশধরা বুঝল কিছু বা না।কত স্তোক দিয়া গেল,তরপর যে লাউ সেই কদুই।কাপড়ের খুঁটে মুখ মুছল শশ।

বুভুক্ষ ভোঁদড়গুলোকে শিকার করা কুচো চিঁংড়ি,তিত্ পুঁটি আর কাঁকড়া দিলে মহানন্দে তীক্ষ্ন চীৎকার করতে করতে সবই খেয়ে নিল।

নৌকার ছইএর নীচে বসে কাদের আর মুন্সি ওদের মুখরোচক খাদ্য খাচ্ছে হাপুস-হুপুস করে।গৌরাংগ হাল ধরেছে।ওরা সবাই আনন্দিত। রন্জন এবার  গান ধরে আনন্দের।সবাই পুলকিত।কাদের ভুড়ুক ভুড়ুক করে তামাক টানে।

সবার খাওয়া শেষ হলো। শ্রান্ত চাঁদ আকাশের দেয়ালে হেলান দিয়েছে।ওরা  নলখাগড়ার কাছাকাছি এসে জাল নামাল,ভোঁদড়গুলো ঝপাং করে পানিতে নামল।ওরা তড়িৎগতিতে বনে ঢুকল।তাড়িয়ে নিয়ে মাছগুলোকে ঠেলে পাঠালো জালের ভিতর।রন্জন আর শশধর জাল টেনে উঠালে অতি উৎসাহি রন্জন,গৌরাংগ আর মুন্সি চীৎকার করে উঠল আনন্দে।কাদের বলে উঠল কিরে কি মাছ!আরে দেখেন না এদিকে আইসা। কাদেরের আর আসতে
হলো না,প্রচণ্ড এক টালমাটাল ধাক্কায় ওরা কে যে কোথায় ছিটকে পড়ল।শশধর নলখাগড়ার বিশাল ঘন ঝোপের ভিতর পড়ে সম্বিৎ হারাল।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন সকাল হবো হবো,সমস্ত শরীরে আর একটা চোখে প্রচন্ড ব্যথা।ধীরে ধীরে নলখাগড়ার বন সরিয়ে সে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল।চারপাশে ঘনঝোপ,বোধহয় কোন বসতি নেই ।সংগী -সাথি মায় নৌকাটার পর্যন্ত হদিস নেই।রশিবাঁধা ভোঁদড়গুলোরও দেখা নাই।ওর মনে পড়ল পানির দিকে ঝুঁকে ও দলবদ্ধ মাছের সারি দেখছিলো,নলখাগড়ার এক্কেবারে কাছাকাছি।হঠাৎ প্রচন্ড এক ধাক্কায় ঝপাস করে নলখাগড়ার  ভিতর জলে পড়ল।জলের  ভিতর প্রচন্ড আলোড়নের শব্দে তার অবচেতন মন বিপদের সংকেত পেল।অতি দ্রুততার সাথে সে হাচড়-পাঁচড় করে ধারাল খোঁচা খোঁচা নল-খাগড়ার ঝোপের ভিতর ঢুকে গেল।তারপর আর কিছু তার মনে নেই।

শশধর খুব ঘামছিলো।প্রচন্ড গরম আর  ক্লান্তি অনুভবে সে ভিজে লুংগির খুঁটটা দিয়ে মুখ মুছল।তার বাঁ দিকের গাল বেয়ে  একটা লোহিত ধারা নেমে মিশে গেছে,তার কর্দমাক্ত শরীরে।ফোলা বাম চোখটা বন্ধ এবং প্রচন্ড বেদনায় টনটন করছে।ওর নিজ স্ত্রী- পরিজনের কাছে ফিরতে হবে।ফিরতে হবে আপনার  ক্ষুদ্র 'বাবুই' কুন্জে।কাছেই রন্জন পড়ে আছে নিথর নিস্পন্দ।

Wednesday 1 June 2016

Unsung gone Sudha..

Sudha, Selim and Tahir were friends. They were friends since their very early childhood. Sudha and those two boys lived in the same locality. They were neighbours. Sudha and Tahir's houses were adjacent to each other while Selim lived in a house of may be few hundred feet down the road. They used to play together, sing together and even fight together like every other teenagers. While they had few other companions but the bonding between these three was very remarkable.

The surrounding atmosphere in those days was very calm and quite and very peaceful. Numbers of trees with plentiful fruits and flowers were the prime attraction for the children. During the summer, monsoon and winter Selim and Tahir along with other friends used to climb up the trees and pluck fruits. Sudha used to get the lion's share of every fruits and flowers collected by the them. These two boys also felt a kind of affection for Sudha. Their days was filled with laughter and merry making round the year and their days were happily passing by.

Time kept on passing rather quickly. Sudha, Selim and Tahir and all of their other friends stepped into their youth. Some stopped studying while some others continued like the three main characters of this story. Sudha and Selim got them selves admitted into the university while Tahir chose college for a polytechnic study.

As the years went by Sudha, Selim and Tahir's friendship with other boys and girls gradually became minimal but the bond between these three friends remained as strong as it was before. Eventually, Selim and Sudha were elected general secretary and cultural secretary in their university student's forum.

Sudha and Selim were from a middle class family. Sudha's father was a school teacher and Selim's a publisher while Tahir's father used to look after family owned businesses which seemed to be always flourishing. There existed a good relationship among the three families too in spite of the economical differences.

Then little by little clouds started rolling in and covering up the otherwise peaceful blue sky. An uproar of citizens from all walks of life started against the then Pakistan government in power. Very regularly students started going for picketing and public processions. One day from one such procession police arrested Selim and sent him to jail on charges of treason as Selim was vocal against the oppression and discrimination done by the government.

Selim faced a traumatic period in jail being subjected to inhuman torture and countless interrogations. Only on few occasions the jail authorities permitted Sudha to visit Selim. She used to feel sad and depressed seeing the visible torture marks and scars on Selim. On one occasion she asked Tahir, if he would like to visit Selim but he denied with a lame excuse of work. She felt that Tahir had changed but she could not comprehend the reason.

One day, Tahir returned a book to Sudha that he had borrowed earlier on. As she was about to shelf the book, an envelop slipped out from inside and fell to the floor. The envelop was secretly tucked inside the pages. She picked up the envelop and opened. To her surprise she found a letter from Tahir.. a love letter! Sudha's life at that point was fully encumbered by student politics in a turmoiled time. The letter didn't carry much of a meaning to her and she sort of felt a disinterest in the love letter and Tahir. She put the letter in her drawer and never spoken about it and never did she express her feelings or speak of this matter to Tahir or anyone.

Eventually Selim was released from jail under general amnesty from the government. But in the greater political arena the people's movement and demands kept on going unheeded. On one fateful night the government unleashed its military might on ordinary people with brutal savagery.. The country headed for war.. A war for Independence.A war for the independence of the country  namely Bangladesh. An armed war to free the country from foreign ruler and to establish a sovereign country.. where people will have freedom.. Freedom of expression and freedom of using their mother tongue. People from all walks of life revolted and joined the pro-liberation forces. As the war unfolded its bloody chapters a group of Bengali people betrayed their own brothers and started working with the then government of Pakistan and formed a militia whose job was to hunt down and kill supporters and sympathizers of the pro-liberation forces.

Few weeks after the start of the war Selim secretly left home to join the freedom fighters. His agenda was such a secret that he did not even reveal this to Sudha.  It happened to be few days before Sudha's birthday. Before going out on his secret mission he met up with her and gave a beautiful small box as a birthday present, telling her not to open that before her birthday. Inside was a blue envelop laid along with some Spanish cherry.. another love letter for Sudha!

Selim wrote as Sudha read through: 'Sudha my dear, Forgive me, I could not inform you earlier as I was in a haste to leave this place and join the freedom fighters training camp. After the training I will fight shoulder to shoulder with my comrades to fly the flag of our independent country. I promise I will fight till my last breath and till my last blood drop. Last of all I want to say Sudha, I love you. Your memories will inspire me to reach my goal. I promise I will be back in a sovereign country. After I come back I dream to build a home of our own. Together we will work hand in hand to rebuild our new born nation. I hope I will be able to conquer your heart by this time'.

Sudha broke down in tears, firstly tears of joy of feeling loved and next she felt scared about the fate of Selim. She thought about the dangers Selim has put himself in.. he may not come back alive. She realized she also actually subconsciously loved Selim but only she didn't know it. The letter had dug out her love. Sudha preserved the letter carefully.

During the war the Pakistani army and the militia was jointly taking part in rampant killing, arson and looting all through out the country. Savagely trying to wipe out the desires of freedom from all Bengali people. Town after town came under blitzkrieg, village after village was wiped out. Out of fear millions of people left their dwellings and marched to neighboring country as asylum seekers. On that fateful day Sudha's neighborhood was rocked by the sounds of military trucks, gunfires and screams. Houses of Selim and Sudha were set ablaze. Sudha's mother an woman of fifty was taken as prisoner to the army camp and her father mercilessly beaten and stabbed with bayonets till he breathed his last. The gang of militia and army was led by a young man wearing a face cover. She was shocked to recognize his eyes.. those eyes she knew since her childhood.. it was none other than Tahir! Sudha was taken forcibly to Tahir's house.

Sudha was held captive at Tahir's house. Everyday Tahir would talk to her and try get her to consent to his marriage proposal. First few weeks Sudha was depressed to the point that she thought of committing suicide. As she settled down further in her current situation she thought she could do something for her motherland and at the same time also punish the traitor Tahir. Sudha agreed to his marriage proposal..

Months passed by while Sudha kept busy creating her image as a devoted wife to earn Tahir's trust. It appeared that she had surrendered to Tahir and accepted her fate. Nevertheless Sudha secretly used to maintain liaison and communication with an informer working for the liberation force to get news of Selim. Another few months later, one day in the month of November she hatched her plan. It was Tahir's birthday and she said to her husband that she wanted to cook some special meal on his birthday occasion. She requested him to send grocery home from the local grocer named Malek mia.

That night, while Tahir was busy listening to the news, very quietly through the back door left opened by Sudha entered some nine or ten freedom fighters in Tahir's house. There was no resistance from any of the guards, they appeared to be either unconscious or in deep sleep. They took possession of the store room and the arms and ammunitions stored there in. Then silently four men crawled up the staircases as shadows while others remained at the courtyard guarding the entrances. All of their guns were loaded and raring to go off at seconds notice.

The assault team took position in front of the door. As they were taking preparation to ram the door open, they noticed the door moved a bit. They froze and then sighed in relief as they realized the door was open. Time to time it moved whenever some breeze comes in. As planned they dashed inside with guns pointing forward ready to shoot. They came to a shock!  There was three bodies lying scattered on the floor: a man and a woman and that of an elderly lady.

They were confused and puzzled at what happened. They came to raid the house and kill Tahir, the traitor behind many armed assaults and murders of ordinary people in that area. As per information from their informer that night was Tahir's birthday and he would be at home...

As promised Selim had returned to an independent country Bangladesh. He later received medal of honor as a valiant fighter and his name is uttered even today like many other freedom fighters. But nobody knew how Sudha breathed her last until Selim met Malek, the grocer of the area..

"I know what might have happened.. I am Malek the informer and local grocer. That night Sudha cooked very delicious food together. She spiked her recipe of spicy yogurt drink with other 'very special' ingredient obtained from me. I do not know how she died but all she told me is that she was going to kill Tahir with the poison. Whether she drank willfully or she was forced to drink under circumstances to execute her plan that we may never know. But she successfully carried out the plot as the armed guards of Tahir's house was also found dead. Our comrades raided the house without any resistance at all."

Selim appeared to be shell shocked as if the whole world was crumbling down on him. He could hear Malek's voices coming from a far..
 
".. I buried her in the quietness of the bushes where you all used to play when you were young. I was the only one to offer a prayer as nobody volunteered in the burial"

Sudha started her eternal journey unwept and unsung. In no history her name was depicted as a soldier of liberation.

ত্রাস

অনবরত একটা ত্রাস মালেককে  তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সে জানেনা কবে  সে মুক্তি পাবে এর হাত থেকে।মুক্তি তার চাই -ই  চাই।কিন্তু সে জানে না সে মু্ক্তি কি ভাবে আসবে। কখন আসবে।কে সে নমস্য ব্যক্তি যে তাকে মুক্তি দেবে।কিন্তু  মুক্তি যে তার চাওয়া।এভাবে কেঁচোর মত বেঁঢে থাকা।সে দুমুঠো কম খেয়ে হলেও নিষ্কৃতি চায়।দুর্যোগ,ভয় নিরাশা তাকে এই বয়সেই অনেক
ভাবতে শিখিয়েছে।

 শৈশবএর কটি বছর কেটেছিলো নিশ্চিন্তে।
 ফর্সা সোনালী  পূর্নিমার চাঁদের মত  মুখ ছিল মায়ের। ঝকঝকে ফর্সা নীল কাঁচের চুড়ি  পরা দুটি হাত পরম মমতায় ওকে স্নান করিয়ে দিত।অবশেষে ভেজা কাপড়ের উপরে একখানা গামছা জড়িয়ে ওর হাত ধরত।
এক পাঁজা মাজা বাসন কোসন থাকত আর এক কাঁখে।কোমরে কালো ঘুনসির সাথে বাঁধা থাকত একটি ঘুঙুর । শুধু কি ঘুঙুর, ঘুনসির সাথে আরো বাঁধা ছিল একটা ধপধপে সাদা কড়ি আর একটা ফুটো পিতলের পয়সা।ওটি নাকি পাকিস্তানি আমলের' হয়সা'।  ওর দাদী বলত।এ দুটি ছিল অমঙ্গল আর অশরীরী অশুভ আত্মা থেকে রক্ষার রক্ষাকবজ। ন্যাংটো  দিগম্বর সে এগুতো  মাযের  সাথে সাথে। হাঁটার  তালে তালে কোমরে  কালো ঘুনসির সাথে বাঁধা  ঘুঙুরটি বাজত টুং টুং ..টুং টুং। পাছে খেলতে খেলতে সে দুরে কোথাও চলে যায়..মা আর দাদী তাই সাবধানতায় সবসময় তার ঘুনসির ঘুঙুরের আওয়াজ এর দিকে কান পেতে থাকত।। 


তার বাবার কোনো স্মৃতি তার কাছে নেই। ভালবাসা স্নেহ আলিঙ্গন কিছু স্মরণ পড়ে না তার। শুধু ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে কেউ একজন দোকানে নিয়ে একদিন একটা লাবেন্চুস কিনে দিয়েছিল। মা মাঝে মাঝে থম মেরে বসে থাকত। ওর  তখন বড় খারাপ লাগত। সেদিন গুলোয়  দাদী রান্না বাড়া সব করত। আর গজ গজ করত,পুংটা পুলাডা মরেও না। কারা সব লোকজন আসত। কেমন যেন লোকগুলো। দাদির প্রায় পড় পড়  ঘরটায় যেয়ে হই-হল্লা করত। দাদী ঘরের ভিতর গুমসাতো,মর মর  অলাউডা  হইয়া মর্। মা ঘরের কোনে জড়-সড়  হয়ে বসে  থাকত। 'হারামজাদা মরেও না।মরলে হিণ্ণি দিমু মাজারে'।
মা তখনও ওকে ঘসে মেজে চকচকে করে রাখত।
বড় হবার পর,ওর বাবা মারা যাবার পর ওর মা ওকে গল্প বলত। তার জীবনের গল্প। গল্প বলার সময় মা যেন কোথায়  হারিয়ে যেত। শুনেছিল ভাগ্যান্বেষণে দাদা তার যৌবনকালে সরিষা বাড়ি থেকে ময়মনসিং এর  জামালপুরে আসে স্ত্রীর হাত ধরে। জীবিকায় ছিল একজন দর্জি। সবাই ডাকত 'হ্যালাল' খলিফা বলে। হেলাল এর স্ত্রী হনুফা ছিল বুদ্ধিমতি আর সহনশীল। সংসারে উন্নতি হতে থাকলো,ওরা দুজন কিছু জমি জিরেত ও করলো। সংসারে এলো স্বচ্ছলতা আর সুখ।ছোট সংসার তিনজনের-  হেলাল,হনুফা আর ওদের একমাত্র ছেলে কাসেম। কিন্তু বিধি বাম।

 খলিফাও মরলো সংসারে ও ভাঙ্গন ধরল। আস্তে আস্তে হনুফার ছেলে বিগড়ে যেতে থাকলো।পাড়ার বদ ছেলে পিলেদের  সঙ্গে মিশে এ হেন কু কর্ম নাই  যাতে সে  লিপ্ত হলো না।রাগ,বকা ঝকা কোনো কিছু করেই ছেলে কাসেম কে ফিরতে পারল না হনুফা।কাসেম এর উত্পাত ক্রমশ বেড়েই চলল। আমারে গাং এ ভাসাইয়া  দিয়া ব্যাডা মাটির তলে হান্দাইছে,গতপ্রান স্বামীর ওপর অভিমান করে হনুফা স্বগোত্উক্তি করত।উপায়ান্তর না পেয়ে চিরাচরিত বাঙালি মায়ের পথই অনুসরণ করবে বলে মনস্থির করলো হনুফা।
ভাবলো নিশ্চয়ই সুন্দরী বউ ঘরে আসলে কাসেম এর মন গৃহমুখী হবে..কিন্তু ততদিনে কাসেম হয়ে গেছে 'কাসু গুন্ডা' ।বিকৃত করে কেউ কেউ বলে 'কাইসসা গুন্ডা'।অবশেষে কাইসসা গুন্ডার মা সুন্দরী  মেয়ের খোঁজ পেলেন।  ইসলামপুরে হত দরিদ্র  বাপ মাযের ঘর আলো  করা রূপসী মেয়ে। হনুফা আর দেরী না করে তড়ি ঘড়ি বউ নিয়ে এলেন ঘরে। মেয়ে আবার নাকি ইস্কুলেও পড়েছে পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত।
বিয়ের সময় মা লক্ষ্য করলেন ছেলের চোখে মুগ্ধতা। মুখ টিপে হাসলো হনুফা।এইবার ছেলে জব্দ। সারাদিন বৌএর আঁচল ধরে ধরেই ঘুরবে। তাতে আপত্তি কি!এটাই তো তার চাওয়া। সোনার ছেলে কাসেম ঘরমুখী হবে। ভাগ্যদেবী তখন মুচকি মুচকি হাসছে।  মাত্র বোধহয় চার কি পাঁচ দিন। এর ভিতরেই কাসেমের চোখের ঘোর  কেটে গেল। বেরিয়ে গেল বন্ধুদের সাথে। ফিরল পাঁড় মাতাল হয়ে। খিস্তি-খেউর করে সোহাগী আর হনুফার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ল। কাসেমের বর্বর দাবির মুখে ভেসে গেল জমি-জিরেত। সর্বকালের মত লোভী স্বার্থাণ্বেষি মহল তো সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো এবার তারা এর সদ্বব্যবহার করতে দ্বিধা করল না।

  
সেই শুরু হলো তা আর থামল না কোনদিন যতদিন না..
কাসেম পোশাক চরিত্র দুইই পাল্টে ফেলল ।তার পরনে এখন, চকরা -বকরা রং-চং এ সার্ট। গলায় লাল সিল্কের রুমাল। ডান  হাতের  আঙ্গুলে রুপো  বাঁধানো সবুজ পাথরের আংটি । সবাই জানে ওই হাতের এক ঘুষিতে কাসেম গাল মুখ ফাটিয়ে দিতে পারে। কোমরে গুঁজে রাখে দুমুখো স্প্রিং এর ছুরি । গায়ে ভুরভুর করে সস্তা সুগন্ধি।ঘরে ঢুকেই খিস্তি শুরু করে দেয়,
ওই ফহিন্নির মাইয়া  ফহিন্নি জলদি বাত দে। ওই মা তুই মরছস নি। ট্যাকা বাইর কর ।জলদি কর ক'লম। ঘরে ক'লম আগুন লাগাইয়া দিমু। ভয়ে সুড় সুড় করে টাকা বের করে দিত হনুফা। আর পুত্রের মৃত্যু কামনা করত। ততদিনে সোহাগীর ঔরসে মালেকের জন্ম হয়েছে।প্রথম কদিনের সোহাগির সাথে রাত্রি যাপনে মালেক বীজ বপন করেছে। মালেকের জন্মের পর বলে, কই থাইক্কা পেট বাজাইয়া বাচ্চা পয়দা করলি। হালি নডি। মা যে কই থেইকা ধইরা আনছে বেশ্যাটারে ।
সোহাগী আর হনুফা বাচ্চাটাকে লুকিয়ে রাখে। কাসেম এর সামনা-সামনি হতে দেয় না। তবুও কবে যেন একদিন কাসেমের সামনে পড়ে  গেল মালেক। 
এত সুন্দর ! এত সুন্দর শিশু! এটি  নাকি তার সন্তান। বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো।তখনতার বছর দেড়েকের মত বয়স।
এত সুন্দর ! এত সুন্দর ফেরেশ্তার মত !ফেরেশস্তা দেখতে কেমন কাসু জানে না।তবে মনের গহীন কোণে তো এমন ছবিই আঁকা। এটি তার সন্তান! বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো। আরো একদিন কাসু গুন্ডার সামনা সামনি পড়ে গেল মলি ওরফে মালেক ।সোহাগী আদর করে এ নামেই তাকে ডাকে। কাসেম ডাকে কাছে। হনুফা আর সোহাগী ঘরের ভিতর থেকে দেখে দুরু-দুরু বক্ষে। মালেক কাছে এলে বলে 'ওই তর নাম কি ? ফ্যাল ফ্যাল করে শিশু মলি চেয়ে থাকে। ওকে সাথে করে দোকানে নিয়ে লোবেন্চুশ কিনে দেয়।ভাবে ছেলেটির সাথে ভাব জমাতে হবে। যতই হোক তার নিজের রক্ত তো বইছে 'অর শইলে' ।
কিন্তু ইবলিশ তো অপেক্ষাতেই আছে কুমন্ত্রনা দেওয়ার জন্য। সামনা সামনি পড়ে গেল ছইল্ল্যা গুন্ডা ওরফে সেলিম গুন্ডার। বড় বড় চুল, সামনের দুটো দাঁত বাঁধানো। মারা-মারি করতে গিয়ে দাঁত দুটো হারিয়েছে। সে বলে কেডা রে ? কোন .. এর পোলা লয়া ঘুরস। কাসেম এর বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। কি তার পোলাডারে কয় জারজ। তার বউ রে কয় বেশ্শ্যা । শোধ লইতে হইব, হময় আহুক। তখনও  বুঝি তার পিতা মাতার সততা আর নিষ্ঠা তার রক্তে বইছিল।তার বুকের কোনে চাপা পড়ে থাকা পিতৃত্ব বোধ জাগরূক হয়েছে । মালেকের নিষ্পাপ চোখ দুটো তার মনে দোলা  দিচ্ছিল।এর আগে সে নিজেই কতবার তার জান পেহচান বন্ধুদের সামনে সোহাগী কে এমন কুত্সিত ভাষায় গাল দিয়েছে। সে মনকে বুঝ দেয় নিজের বউ কে সে যা খুশি তাই বলতে পারে তা 'অন্যে কইবো  ক্যান' ?এত্ত  বড়
সাবাস!
সেদিনও রাত করে বাড়ি ফিরে খেতে চাইল..গলার স্বরে যেন ঢিমে সুর।শাশুড়ী বউ চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে।নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে নীচু গলায় বলে পান দেও।ওরা দুজন অবাক।এ কোন অজানা ভাষায় বিশ্রমভ্বালাপ শুনছে। দুজনের চোখে অজস্র ধারায় নোনা স্রোতের ঢল নামে।শিশু মালেক নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় ঘুমিয়ে রইল।জীবনের এসব টানা-পোড়েন তখনও আঁচড় কাটেনি ওর গায়ে।

সকাল হলো । আজ সোহাগীর যেন সূর্যটাকে বড় বেশি সুন্দর লাগলো।হনুফার মনে হলো মুরগীগুলো যেন সেদিন দর্মা থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য কম উৎপাত করছে।আহ্..সুদিন কি আগতপ্রায়!সুখস্বপ্নে ওরা বিভোর।ঠিক তখনই মূর্তমান শনি ছইল্ল্যা গুন্ডা সাংগ পাংগ নিয়ে এসে ষাঁড়ের মত  চীৎকার করে।'ওই হারামজাদা কাইস্যা,গেলি কই,..পুত জলদি ল।কামে যাইতে হইব না?কাম যে কি! খোদাই জানে। কোথায় যে কার কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছে কে জানে!ধড়-মড় করে উঠে তাড়াতাড়ি সার্ট গায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেলো।সেই যাওয়াই  শেষ যাওয়া।আর কোনদিন সে ফিরে এল না। কথায় বলে সুখের চেেয়ে শান্তি ভাল,শান্তির চেয়ে স্বস্তি ভাল।।

সেদিন নতুন তিন সাগরেদ এসে জুটেছিলো ছইল্ল্যার সাথে। প্রমোদ,নকিব আর মতলুব। নতুন নাম লিখিয়েছে বুঝি বা দলে। প্রমোদ এর মাথায় বারান্দা দেওয়া কালো টুপি,পরিধানে কালো শার্ট,কালো জিন্স এর প্যান্ট। কুকর্ম করে অন্ধকারে উধাও হতে বড় সুবিধে। নকিবের দোহারা নোংরা চেহারায় এক গাল তদুপরি নোংরা দাড়ি। কুকর্ম করতে নাকি ওর জুড়ি নেই। আর মতলুব ছোটখাটো চেহারায় মনে হয় যেন নির্ভেজাল,নিপাট ছোট নিষ্পাপ মানুষ। বদের হাড্ডি। যত বদ কাজের কুপরিকল্পনা ওর 'মস্তিস্ক উদ্ভাবিত'।                                 
তা সুখ হারিয়ে শান্তি খোঁজার অভিপ্রায়ে হনুফা ঘরে সুন্দরী বউ এনেছিল। সুখ রইলো মরিচিকা হয়ে। কাসেম এর এক বেলার দুটো মিষ্টি কথায় ওরা একটু  স্বস্তির আলো ঝলকানি দেখতে পেয়েছিল। বহুদিন পর সুস্বপ্নে রাত ভোর হযেছিল সোহাগীর।হনুফাও অনেদিন পর সে রাতে হযেছিল কাসেমের মা -স্বপ্নে। সেই সুখ,শান্তি ,স্বস্তি কোনটাই এলো না হনুফা আর সোহাগীর  ঘরে  - ওসব অধরা হয়েই রইলো ওগুলো ওদের কাছে।

অজানা আশংকায় ওদের দিন কাটে।তিন চার দিনের মাথায় সেলিম ওরফে ছইল্ল্যা ওর সাংগ -পাংগ নিয়ে ওদের উঠোনে এসে আসন গাড়ে।
সেলিম বলে,খালা কাসেম কো ?বাবি কই, দেকতাছিনা যে। কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই,'বাবি,বাবি চা খাওয়ান তো,বলে কাসেম সোহাগীর শয়নকক্ষে হাজির হয় সেলিম।অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে সোহাগী আর হনুফার। সাহস করে হনুফা বলে, তোমারি তো জানার কতা,তোমার লগে ঘুরে-ফিরে, বার হইল তোমার লগে। নিমেষে সেলিমের চেহারা পাল্টে গেল। বদলে গেল গলার তরল স্বর। পরিবর্তে খসখসে গলায় বলে উঠলো, আইলাম চা খাইতে। আজ তিনদিন ধইরা হ্যারে দেখি না। দেহেন কুন বাজারে মাইয়া  লোক লইয়া পইড়া আছে। হালার চুরিত্রের দুষ আছিল। গরে  বউ থুইয়া আকাম-কুকাম কইরা বেড়াইত ।ওর সঙ্গীদের পরস্পরের মুখ চাওয়া -চাওয়ি হনুফার দৃষ্টি এড়ালো  না। সেদিনের মত ওরা দলে বলে নিষ্ক্রান্ত হলেও বাড়ির চারপাশে ওরা ঘুর-ঘুর করতে শুরু করলো।ঘন ঘন আসা যাওয়া শুরু হলো ছইল্ল্যা আর ওর  বন্ধুদের।এদিকে বাতাসে ভেসে আসছে গুজব ছইল্ল্যা আর তার দলবলের কাসেম কে খুন করে খালে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা।
দুই বেদনাদ্র অসহায় নারীর বুকের গভীরে নীল ক্ষত।এক মা যার জঠরে জন্ম নেয়া সন্তান মালেক বুকের বহমান ফল্গুধারায় তিলে তিলে বড় হলো।আর এক নারী যার যৌবন ও  হৃদয় লুন্ঠিত  হলো এই একই ব্যক্তি দ্বারা।কি বিচিত্র মানব জীবন।আজ তার জন্যই ওরা নিভৃতে চোখের জল ঝরায়।

চুপি সাড়ে কেউ একজন জানিয়ে গেল কাসেমের দূর্গতির খবর।আর ওদের এই ভিটে-জমিটুকুর দিকে নজরের কথাও জানা গেল। ছইল্ল্যার সোহাগীর প্রতি লালসার কথা তো কারো অজানা নয়।মালেকের প্রতিও ওদের নজর পড়েছে  শুধু ওরা আছে সুযোগের অপেক্ষায়। প্রধান পথের কাঁটা কাসেমেকে ওরা উপড়ে ফেলেছে।

আতংকিত হনুফা এবং সোহাগী এবার মালেকের নিরাপত্তায় মনোযোগী হয়।ততদিনে মালেক পাঁচ বৎসর পার করেছে।অবুছ শিশু।সোহাগীর বুক দুরু দুরু করে।এরপর হতে সোহাগী মালেককে নোংরা রাখা শুরু করে। সোহাগী নিজেও এলোমেলো নোংরা হয়ে সৌন্দর্য  চাপা দিয়ে লোকের কুনজর থেকে পরিত্রান খুঁজে।

 মালেক ক্রমশ বড় হচ্ছে।লাউ ডগার মত ধড় ধড় করে।কিন্তু সে যেন পোলোয় আগলে বড় করা গৃহস্থর মুরগী-ছানা।হাতে -পায়ে সে বেশ তাগড়া হয়ে উঠছে।ওর মা আর দাদীর তো বুক কাঁপে থরথর।কি অদ্ভূত পুরুষ মানুষ তাড়াতাড়ি বড় হচ্ছে এতে এতো আতংকিত হওয়ার কি ঘটল বয়স যে মাত্র বার হলো!

ছইল্ল্যা আবার একদিন এলো হনুফার ভিটেয় বলা বাহুল্য দলবল নিয়ে।এসেই হুন্কার তুলল চা খিলান খালা।দরজার চৌকাঠে বসা মালেক বলে ওঠে,আমাগো বাসায় চা খাইতে আইছেন,আমাগো তো সব গেছে।আমরা চা পামু কই? ভাতই পাই না।

নির্লজ্জ ছইল্ল্যা অতঃপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে বলে,খালা এইডা তোমার নাতি ?বড় ক্যাডর ক্যাডর করে তো।তা খালা তোমারে একডা কথা কইতাম আইছিলাম।আমার বাপ-মা থাকলে হেরাই কইত।

খালা গম্ভীর স্বরে বলে কও কি কইবা।হনুফা তার অভিঞ্গতা থেকে আঁচ করতে পেরেছে কথা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে।ছইল্ল্যা বলে আপনেগো কষ্ট আমি বুঝি।আপনার নাতি তো কয়াই ফালাইল ভাতের কষ্টের কথা। তা আপনারে তো কইতে শরমাই।আমি সোহাগীরে বিয়া করতে চাই।
কি কইলা,হনুফা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
খালা হুধা হুধাই চ্যেততাছেন।আগিলা বউরে লাথ্থি দিয়া বাইর কইরা দিমু।
মালেক উঠে দাঁড়িয়ে আকস্মিক ভাবে চীৎকার উঠে,বাইরান বাইরান কইতাছি।
হনুফা আর সোহাগীদুজনে দৌড়ে এসে মুখ চেপে ধরে মালেকের।পুলাপান মানুষ মাফ কইরা দেন যুগপৎ বলে ওঠে  তখন হনুফা আর সোহাগী।কিন্তু ধনুক ছেড়ে তীর যে তখন বেরিয়ে গেছে। ছইল্ল্যার চীৎকারে ছোট ভিটেটুকু থর থর করে কেঁপে ওঠে।আর সেইসাথে কেঁপে ওঠে হনুফা আর সোহাগীর কলিজা।বিস্ফারিত চোখে ওরা বারবার অনুনয়-বিনয় করতে থাকে।সেলিম গুন্ডা শপথ করে, 'খুব বাইড়্যা গেছস বাপের লাহান।খাড়া ইবার(?) তর মুন্ডু ফালামু,আমি যদি হইয়া থাকি বাপের ব্যাটা ছেলিম'।

আতংক গ্রাস করে মালেকের মা ও দাদীকে।দুজনের নজরবন্দী মালেক অস্থিরতায় ভোগে।ইস্কুল যাওয়া আসায় দাদী সংগী।মালেক হাঁপিয়ে ওঠে।সহ-পড়ুয়াদের হাসির খোরাক হতে আপত্তি!মালেকের দাদী পরে বোঝায়,হুনছস তো আজরাইল কি কয়্যা গেল্।আইচ্ছা ঠিক আছে আমরা
এহন থন হোজাহুজি না গিয়া যামু ওই  আকন(আকন্দ) বনের ভিতর দিয়া।
মালেক বলে,'ঐ দাদী উয়ানে তো মাইনষে আগে'।দাদী প্রতি উত্তর করে আগবই তো।আগব না আগা পাইলে।ল মেলা কর্ দিক করিস না।ছুটি অইলে ওই জংগুলে আমি আবডাল অইয়া থাকমু।তোরে হুক্করি দিমু তুই আমারে দেখবি। হের পর দাদী -নাতি একলগে আয়া পড়মু।

এদিকে মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দে আক্রান্ত সোহাগী।অনবরত টানাপোড়েনের নিষ্ঠুর খেলায় সে শ্রান্ত।বিধ্বস্ত তার দেহ-মন।চিন্তাচ্ছন্ন মন তাকে প্রশ্ন করে কিভাবে রক্ষা করবে তোমার স্নেহের ধন কলিজার টুকরা।ছাচরা মাছওলি জরিনা ইংগিত দিয়ে গেল হনুফার অগোচরে,'আমার মুনে লয় ছইলল্যার পসতাবে রাজি অয়নই বালা।পুলাও বাঁচপ ,তুমার জায়গা জিরেতও বাঁচপ'।মালেককে সে হারাতে চায়না কোনো ভাবেই। আবার তার ঘৃণা-সেলিমকে দেখলেই তার 'উটকানি আহে'।আর মালেকের বাপের প্রতি তার  একপেশে ক্ষীন 'মহব্বত' তো এখনও বিদ্যমান।আর মালেক তার সাত রাজার ধন মালেক! এভাবে মালেককে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে কি তার চক্ষুশূল হবে না?মনে মনে বলে,'জরি তুমার কতা চিন্তা করসি,তয় উয়া তো অয় না। একডাই পুলা আমার! কইলজার টুকরা।   

হনুফা আর সোহাগীর এই সবসময় আগলে রাখা, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকা প্রভাবিত করে মালেককেও।মালেক যে এখন বই পড়ে।সামাদ স্যার কত ভালো ভালো কথা শেখান।বলেন নির্ভিক হতে, সাহসের সাথ সব মোকাবেলা করতে।কিন্তু ছইলল্যার গণগণে আগুন চোখ আর ক্রুদ্ধ মূর্তি ওকে একবারে মুরগী ছানার মত মা-দাদীর ডানার তলায় লুকিয়ে ফেলে।খুব ভয় খায় যখন অনেক দূর থেকেও ছইল্ল্যাকে দেখে।ছুটে এসে  ঘরের কোণে লুকিয়ে পড়ে।আর সব সব ছেলেরা কেমন মাঠে বল খেলে।ও তো যেতে পারে না,পায়ে যে শিকল বাঁধা-মা আর দাদীর আকুির শিকল।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় পড়া শেষে চৌদ্দ বছরের কিশোর মালেক তন্ময় হয়ে পড়ছিলো রবি ঠাকুরের 'বীরপুরুষ'কবিতাটি।ঘুম পেয়ে গেলে বিছানায় মা আর দাদীর মাঝখানে শুয়ে পড়ে।মা আর দাদীর পাশে থাকে সবসময় একটা করে দা' আর কাঠের শক্ত পিঁড়ি।আত্মরক্ষার জন্যে।শুতে যাওয়ার সময় প্রতিদিন মালেেকের ভয় করে।সেদিনও গেল ঘুমুতে সে মনে ভয় নিয়ে।

সবাই ঘুমুচ্ছে ।খুট খুট একটা আওয়াজ হচ্ছে।ঘুমের ঘোরে মালেক দেখল একটা ভীষণ-দর্শন জন্তু ঘরে ঢুকছে।মূহুর্তের মধ্যে সে দাও নিয়ে ছুটে গিয়ে এক কোপে মাথা ফেলে দিলো জন্তুটার।আঃ !এক মূমুর্ষ চীৎকারে তার সম্বিৎ ফিরে এলো। সে খোলা দরজা দিয়ে ছিটকে ঘরের দাওয়ায় এসে পড়ল।দু টো গুন্ডা তেড়ে এসেছিলো তার দিকে ।কিন্তুু তার রণচন্ডী মূর্তি দেখে ভয়ে পালাল।ঘরে পড়ে আছে ছইল্ল্যার মাথাকাটা নিথর দেহ।

মালেকের আর ভয় করছে না।

সকাল হলো,লোকে লোকারণ্য হয়েছে তাদের ভিটে।পুলিশ এসে নিয়ে গেল মালেককে।সবার চোখে মালেক-চৌদ্দ বছরের মালেক আজ বীরপুরুষ!!

সমস্ত বিবরণ শুনে আর বয়স বিবেচনায় বিঞ্গ আদালত মালেককে তিন বছরের জন্য কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠালো।

সংশোধণী কেন্দ্রে মালেকেকে আর ত্রাস তাড়া করছে না। আজ সে মুক্ত।


Monday 30 May 2016

The invisible meeting

Gradually Joseph's nature transforming to a bohemian one.Perhaps' nonconformist' should be the appropriate word to define the nature of Joseph.So we can consider Joseph as a nonconformist.And eventually turned to  a typical nonconformist by his activities of roaming around and around.Other virtues of character if considered was pleasant and her mother rather had no complain against him.He was an intelligent boy with soft nature. He was neither orthodox too. He had a feelings of hatred towards any kind of addiction that many conformist possess.Joseph inherited these traits from her mother.He saw her mother wept for his father secretly even after long many years of his leave.

Joseph and Andrew were known to each other since their toddler stage.They used to live in two adjacent  attached small house. Their fathers were not so well-off.Since the families were small in size,these two intelligent house making mothers could however manage the food,the clothings etc with their husbands' little earnings. These two children along with the other siblings used to play in the nearby park in summer.The mothers accompanied the children,kept themselves sitting on the chair of the park and chatted  with each other.In the winter they often along  with their other siblings visited house of each others  and played happily together.

They  grew quickly,passed their childhood days and entered the college.Joseph was very talented while Andrew just keeping on.Joseph used to cut highest numbers in class.So the teachers gave an extra attention to Joseph and  specially Dr. Goodwin was very hopeful about him.But then already started the pulling up of the curtain of drama.

During a semester break Joseph and Andrew went out of the city to break the monotony.With little money that they could manage from the mothers they started from the local travel agency office. They enjoyed but quickly finished both the money and vacation like anything interesting and tasty that finishes very quickly.Joseph and Andrew returned home and again started their semester.Then the thing happened..

Joseph informed Andrew about the advertisement of a local tourist department .
Joseph said,'Look Andy.this office offering low price for going..'
Andrew:Yes its possible.Its a off season.But why you are so excited.
Joseph:Look so cheap!Possibly our monthly pocket money is enough for this small trip.
Andrew:Are you crazy! In the mid of the semester  should we waste our valuable time?
Joseph became disappointed and with slow small steps he left the place.He knew Andrew was determined and would not swallow the bait.

Then last subsequent few days Joseph did not attended the classes.He was not found anywhere as if he was vanished.On a sunny Tuesday he was again discovered in the class by Andrew.And Andrew took his seat beside Joseph.With smiling face he asked 'What's up with you'?Joseph whispered ,'You really missed something'.Professor was in the class.
Andrew conceived Joseph could  not escape from the bohemian trait of his father.

Lastly  Joseph declared since he did not feel any interest he would  discontinue the study.Rather he would start working in a local restaurant. He started to work and gave his mother the earnings as family expense.Every six months he started his regular venture of visiting new places.He however did not inherited the irresponsible behaviour of his father Mr Donald.Joseph became a ruck-sack tourist.
Other than shedding tears what more the mother could do!


After the end of each  of his travel Joseph came to Andrew and loved to narrate the gathered experiences.While explaining Andrew perceived Josephs dazzling eyes. Andrew no doubt enjoyed all the delightful stories of  Joseph.The friendship between these two young chaps remained as deep as before.Now we enter the main story.

Last autumn Joseph traveled France.It was not far from  their place.Joseph liked to roam alone rather than with the group.He was fond of wandering the remote areas and be acquainted with local people, their culture and their food.He felt interested  to know the life of  aborigine people too.However that time he traveled remote villages of France.He described his experience of the visit to France.He started..

You know Andrew I like to travel alone.I enjoyed the trip. The villages were well away from the crowds. But all modern amenities were available there.This time I availed the opportunity to stay in an inn.It was a very cheap one and the cost was within my reach.Frequently I used to buy apple,bread and  juice for my lunch. I used to take my lunch usually sitting on the fallen log under a tree,or near the bushes of wild flowers and simultaneous watching and enjoying the natural beauties.This way I could save some pounds too and included more villages in my visit plan.The farmers of the villages used  to produce different crops like sugar,beet,wheat, maize and barley.They owned both large scale and middle range projects.Some were poor too. I mingled with them very closely. Their polite hospitality was remarkable.  'You did not find any problem in communicating?,Andrew interrupted. Oh come on Andrew! You had perhaps forgotten,once I enrolled French language as one of my subject. I did not find much difficulties in the interaction with the farmers.I even visited some farmers in their poultry and animal husbandry farm.


Those few days were not enough for exploring such
a vast area.My wallet also going to be emptied. So I had to start for the main town from where I can avail bus to reach my home.I walked and walked through the narrow road in between crop fields.It seemed that the path will never come to an end.I was feeling hungry.All the foods in my bag finished already few hours ago.There I could not even see a food store. Soon it became dark.'Lucky I am' I felt when soon the full moon crawled up in the sky.At least I could trace the path of my walking,but the wind was becoming cooler.I wished if I could see somebody for help.Any type of help,either it could be  shelter for the night and food or a transport up to the city.


Then I came across a house- a fenced house.There in front of the house were bushes which I felt in the dark to be to be the flower plants.A car was standing in front of the house near the porch.Feeble light coming out through the lace curtained window.I hesitated for a while and then pushing back the gate entered inside the territory of the house.Soon a dog-perhaps a hound started barking .I stopped for a while and following the sound of howling tried to look for the dog.However I could not find it.

I proceeded towards the main entrance of the house.I shouted loudly,'Anybody home'.No body responded.I rang the door bell once..twice..thrice but again no answer.But slowly and quietly the door opened up widely.I waited but could not see any face on the other side of the door. Unethical but slowly I entered the house.In the big living room that I stepped several couches were placed here and there.There  was a big dining table in one side of the room with the chairs in front.I stand still and after a while chose a single chair very near to the fire place.I was waiting for somebody to approach me.I felt drowsy. Only a matter of moments somebody will of course come to me!But instead soon I heard the low voice of many people.Also I felt the stepping sound of many people.I was astonished but considered tiredness and hunger were the causes of hallucination in me. I heard the sound of people's  sitting on the chair. I also felt the very presence of many people in the room. But everything were invisible.

The flame in the fire place was low but enough to make my body warm.I kept waiting for the land lord or land lady.Soon I felt somebody crossed me and then a carriage full of food moved slowly as if somebody pushing it. It stopped and then saw plate full of food floating and coming down on the table and occupying precise place.People were talking with each other in low voices and passing papers to each other. Undoubtedly the noise of turn over of papers I heard!The foods from the plate I found floating at man's mouth height and then vanishing.Subsequently all the foods were finished. Watched the tossing  of the wine glasses in air and listened the whispering of cheers.Without no confusion  I heard quite clearly.

I was scared.I was trembling in fear and felt the flow of ice cool water down my back bone.I was panic struck and stood up.Somebody came to me and offered drink,'Please!' with whispering voice.Her coming I felt with the fragrance of a perfume.I saw two floating bright blue eyes and smiling lips staring at me. I knew nothing until next morning before I saw myself on unknown bed.

The land lord and land-lady entered with some chicken soup and bread.They wished me.I asked them what happened and how I came here.The land-lord described.He told he was driving to the city. In front of the haunted place his car went out of order.He came out of the car and mend it.But his dog was shouting and jumping as if it saw something unwanted or unknown.So he brought the dog out of the car.The dog started smelling and proceeding towards the abandoned place.He had the cross hanging from his neck to protect him from all evil things. He was not scared  and followed the dog and saw me lying unconscious in the bush. And he brought me his home.He mentioned there was no house and no fence and no car.He also added long ago, during the Nazi regime,the Germans occupied the house there.It is said they used to live and often had their meeting in that house.But for some unknown reason one evening it was blasted.There is a hearsay the Nazis were holding an important secret meeting when it was blasted.There still remains some remnant of the house covered by bush.I was listening breathlessly and returned to my full sense ..I need to return.

I enjoyed the story of Joseph.This time I felt he was frightened and also I knew that cannot stop him of traveling.
After two months Joseph again had started for venture.... 

Friday 27 May 2016

The quest

The two were waiting breathlessly in front of the laboratory.One is Saleha and the other Abdel..


Saleha used to keep on staring at the boy blinkless...Abdel observed it several times since he saw Saleha for the first time.He noticed a thirst in her eyes.Saleha tried to go very inside of the heart of Abdel.She was questing for the truth.She felt an urgent need to get the answer of the question of her heart.And this question ringing the bell continuously ..ding..dong..ding..dong.

Saleha khatun was then in Mumbai.  For last one year frequently she had been coming this place with her ailing mother.Her seventy five years old  mother   was suffering long from a chronic disease.Being a  retired person, as a part of her duty and also love Saleha routinely used to accompany the mother. They used to stay in the boarding house for the patient nearby in a walking distance of  the hospital.

Every times she came she would invariably look for the man Abdel Malique.Abdel owned a share of the big boarding house. As a  managing director of the  boarding house he used to keep a close eye on everything.No boarder so far had any complain of mis management and facilities.Boarders checked in and out. Some even resided frequently.But for no boarder Abdel experienced any special  feeling.Saleha's glance,attitude and interest towards him provoked Abdel. And in return Saleha enjoyed an extended extra care of Abdel for them.The man used to visit frequently the room of Saleha's mother. Who was that man, Saleha often asked herself?.The same lips,same eyes and even the smile similar.So many years passed but the memories were  vivid as before.

How can she forget?She remembered it even after three decades.The memories she kept very carefully preserved. It was only her painful passion which no body could share.After such a long time everybody forgotten but not she.Every moment she felt the bleeding inside her.Is it possible to forget the love,the hug she received.Still she kept on feeling the kisses she enjoyed.Excessive adore sometimes made her annoyed.The obsession clutched  her mind severely.

Surely this must be he, but then?she cannot sum up. She felt confused but her hope increasing day after day.She wanted to turn over all the possible stone .

One day Saleha went to the office room of Abdel.
'May I come in'?Saleha said.
Anxiously he stood up and welcomed her.He came forward and helped Saleha to take the seat. She sat down.Abdel said,'Any problem?'
Saleha:No,no problem at all.I came just ..just..
Abdel:Yes,any help?
Saleha:I have a question
Abdel:You can ask if possible I will answer.
Saleha kept quite for moments and then stood up
suddenly.She told that another day she would come.

 Her dilemma forced her to  went up.All the tests of her mother and other formalities with the doctor was completed and Saleha along with her mother checked out the boarding house and started for their own place.She sown some seeds of questions in the mind of Abdel.

The turmoil in Saleha's heart did not stop rather it was intensifying.Abdel also on the  other hand had the continuous hankering.Hankering to explore thing unknown.That storm started in him when he perceived queries in the eyes of this enchanting lady. 

Eventually the date for mother's check up coming closer.Heart of Saleha started dancing since she could see the man of her love.She was determined she would at least say Abdel about her feelings for him.Saleha was already sixty,the man may be at his age of thirty or above.It was not absurd to be..

How long she would wait!It might be he!Saleha was determined to excavate the truth.So this time when in Mumbai Saleha again meet the man.She asked Abdel directly who his parents were.She said,'Every time I see you my heart starts throbbing. Abdel  interrupted,'Madam you want any drink'.Abdel was also thirsty.Thirst for a drink and thirst for..something else!Was Saleha running after the mirage!Who knows?

'For long one year since I saw you for the first time a turbulence l felt inside me.Saleha continued,'I want relief.I want the remedy.And my belief only you can save me. I cannot sleep and cannot eat either'. Abdel kept quiet for moments.Saleha hastily repeated,'you did not answer my question'.

Abdel felt to peep into his own past life.The memories of  early  life before five was very smoky.He kept on turn over the old pages of her life sketch.He took his time.Saleha was very excited and impatiently said, 'Mr Abdel you should understand only you can save me'.Abdel now apprised that Mr Bipin Lahiri and Mrs Uma Lahiri were his foster parents.They were still alive then Abdel added.

Saleha felt she could see little light of hope.She wanted to proceed some more and said,'If you do not mind can you narrate at least briefly how and from where  they got  you?Abdel himself  felt very confused about everything happening since Saleha checked in the boarding house. Before he had been passing a very peaceful life without any disaster.Why that lady was so curious .Is not she trying to invade his privacy?But next moment soft hearted Abdel saw the very miserable face of the woman.That face shook  his mind terribly that he could not deny. He told that he wanted to make himself ready to tell everything.He promised next morning he would try to clear all her questions.He observed two ponds of tear in Saleha's eye.

Whole night both Saleha and Abdel could not close their eyes. Saleha could anticipate a  light of hope. She often used to dream a rescue ship far in the vast sea of her sorrows.She was over sure  she was not wrong.Abdel could remember every thing  of his life in Dubai.But before that  the memory was very hazy he was very much puzzled about it.He only could remember he had parents..how they looked like and where they would live..no! nothing he can remember.He could remember only greeneries,a long road, a small boy may be his brother or neighbour,a school and a pond with ducks.
Saleha already established herself in the soft corner of his heart,Abdel felt.

Saleha guessed there could be a link between her sad part of life and that of Abdel's past which were in crying need of proper investigation.

The middle part of the story was very pathetic.Next day there was a long conversation between Saleha and Abdel.
Saleha started: who were your biological parents then?
Abdel:I do not know.I cannot remember.
Saleha:How and since when you are with the Lahiri family?
Abdel:Since long time. I do not remember  the             exact year and date.Baba Mr Lahiri brought              me here from Dubai that I know.
Saleha: From Dubai? What you were then doing there?
Abdel;I was a jockey for camel race.Saleha was  excited and sat erect and still and became breathless.

Abdel stopped and was lost in the memories of his past life.All these were only his memory munching.He did not express it to Saleha. Those were the nightmare of his life. But now in this crucial time he started chewing the cuds of those bad memories. He remained almost unfed and unwatered in Dubai.The younger and the low weighted a boy the more their owner liked.The whole day he was given only few biscuits and sometimes few very low grade dates.One day he got a chance to steal the food of camel,which were more nutritous, more healthy and perhaps more delicious consisting of milk,honey,dates,barley. While stealing he was caught red handed.The trainer beat him mercilessly and cut two of his toes as a reward of punishment.

Abdel continued telling that year Mr Lahiri as a journalist and a reporter associated with a world renowned social reformist visited the camel race and as well as the training camp and saw me.Along with some other children I was rescued by his team.

Saleha asked if his foster father tried to know his root.Abdel shook his head positively.Then baba posted news in different news paper with the pictures of us.Except few all were brought back by their relatives.Mr Lahiri gave me shelter in his house.He provided me food, shelter,education,better environment,livelihood  every thing that human being needs.

'I think you are now satisfied,'Abdel said.
Saleha unhappily told that it could not be the end, there were something left .Something left to fill up the blank between the years in Dubai and those of before.lt could not solve her problem and relieve her mental agony however!

Knowing everything Mr Lahiri came forward to help Saleha. He enquired of everything.Saleha told that long ago may be almost twenty years or more,she lost two of his sons namely Sumon  and Sohag when they were only five and three years old respectively.
Everyday they used to come to the office she used to work after the school.Their house and school was a mile apart  from her house.During lunch break three of them used to return home together in rickshaw. Saleha used to drop them, fed them and left them in bed of home and returned to office. One day the children did not come..and never they came..they were lost.Since then..

The word 'Sumon' sparked in Abdel's brain.He then could hear a  feeble calling of a female voice 'Abbu Sumon' from far!Instantly he turned his face towards Saleha.So far he was staring at Mr Lahiri.He stared at her as if he was searching something on the face of Saleha.He was shattered mentally all on a sudden.
There started the reverberation of the word 'Sumon'
Mr Lahiri asked if they tried to trace the boys.and he also asked where the husband was.Saleha cast down her eyes and told he left me only after few months of the incident.Saleha answered she tried all her best to trace the boys.


Mr Lahiri expressed his honest desire to help Saleha.He felt heartily the misery of this grief-stricken woman.Saleha brought out a picture of a toddler baby with herself and a young man.She mentioned the boy was his first child Sumon.

Mr Lahiri voiced,'If you want I can arrange the D.N.A test of you and Adel.Only this  and this could give us the confirmatory solution.Without any time killing Saleha agreed, Abdel also not denied.

Then two days after they went to the laboratory let their blood  be collected for the test.It took time and both Saleha and Abdel waiting anxiously and eagerly for the result..

May that could draw an end to Saleha's endless quest.We do not know.

Thursday 26 May 2016

হৃদয় ব্যবচ্ছেদ

তোমার চোখে আলো    -আঁধারের রসময় খেলা।
রবি আর  শশী  খেলা করে বেলা- অবেলা।
পূর্নিমার নেই হিসাবের দিন-ক্ষণ
সর্বদা সেথা মধু-লগন.


সর্বদা সেথা মহামিলন,দেহে হিল্লোল,
চক্ষু বাঙ্ময় ঠোঁটে  কলরোল।
মদির -সুধা সেথা নির্ভেজাল জলে।


প্রচন্ড ক্লান্তি সেথা  নাকি ভোলা  যায় 
শ্রান্তি সেথা  ধুয়ে মুছে আনে প্রশান্তি।

কিন্তু কেন.?
হয়ে ছিল কি কোনো রক্ত ক্ষরণ
সে  হৃদয়ের ঘটেছিল কি কোন ব্যবচ্ছেদ !
বয়েছিল কি মধুমতি দুকুল ছাপিয়ে ।
ভাসিয়ে নিয়ে সব কূল  ।
তবে কেন অভাজনে করো এত হেলা।
নাইবা ভাসালে কৌশলে, ছলে সে ভেলা। 

Tuesday 24 May 2016

পরীর দেশে এনা এবং মিরা

পরীর দেশে
Some rights reserved. This work is licensed under a  Creative Commons Attribution 3.0 License.
এনা আর মিরা ওরা দু'বোন। এনার বয়স পাঁচ আর মিরার মাত্র তিন। ওদের দুটিতে ভরি ভাব.. গলায় গলায় ভাব
যাকে বলে আর কি! এনা সব সময় নিজের হাতের কচি মুঠোয় তার চেয়ে নরম মিরার মুঠিটা শক্ত করে ধরে রাখে।
যেখানেই যায় দু'বোন একসাথে যায়। একজনের হাসিতে আর একজন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। যখন কাঁদে তখন দু'জনই  শুরু করে।

ওদের বাড়ির পাশেই থাকত ওদের এক চাচি। চাচির ঘরের দরজার পাশেই ছিল চমৎকার ঝোপালো একটা বেলি ফুলের গাছ। ছোট ছোট সাদা ফুলে ছেয়ে থাকত। আরও ছিলো সন্ধ্যামণি  ফুল। গাঢ় গোলাপি রংএ শেষ বিকেল ঝলমলিয়ে হেসে উঠত। ওরা দুটি বোন অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখত। কচি কচি সদ্য মেলা পদ্মআঁখি যা দেখে তাতেই  চমৎকৃত হয়।

ওরা দু বোন প্রতি বিকেলে ফুল গাছগুলোর কাছে এসে দাঁড়ায়। সুরভিত হতে ওদের বেশ লাগে....

প্রতিদিন ওদের অবাক চোখে চেয়ে থাকা দেখে চাচির একটু রগড় করতে মন চাইল। চাচি বললেন, "তোমরা বুঝি ফুল খুব ভালোবাসো! বেশ একটূ বড় হও তোমাদের বাগান করা দেখিয়ে দেব। আচ্ছা, তোমরা কি কখনও পরী দেখেছ? জানো  এই উঠোনে নিশুতি রাতে পরী আসে"
এনা প্রশ্ন করে ওঠে, "সত্যি!"
চাচি বলেন "সত্যি বৈকি। আর আজ তো পূর্নিমা ওরা তো আরো বেশি আসবে দলে দলে। তোমরা তোমাদের জানালায় বসে থেকে দেখতে পাবে।"  হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে এনা জানায় সে তাই করবে।

তারপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ওদের মা ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ওরা দুজন বিছানায় অপেক্ষা করতে থাকলো কখন জানালা গলিয়ে চাঁদের আলো আসে বিছানার উপর। আস্তে আস্তে ওরা বিছানা ছেড়ে জানালায় গিয়ে বসলো। জানালার গরাদে হাত রেখে এনা বলল মীরা কে শুনতে পাচ্ছিস 'ওরা আসছে'! মীরা কি ছাই এত কিছু বোঝে! তবুও ওপরে নিচে দুবার মাথা নাড়ে।
সত্যি সত্যি একটা পরী এসে নাম চাচির উঠোনে। ওরা তো মহা খুশি। তারপর ওরা দুজনে পা টিপে টিপে দরজা খুলে বাইরে এসে গুটি গুটি পায়ে ফুল গাছের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। এক এক করে অনেক কজন পরী এসে নামল ফুল বাগানে। কি সুন্দর তারা দেখতে। সোনালী বা কালো লম্বা রেশমের মত ঢেউ খেলানো চুল। কারো চোখের রং নীল কারোর বা কালো। কি তাদের চেহারা। আর পাখা সে যে কত রঙের, আর কত বাহারি নকশার। একটা বাচ্চা পরী এনা দের কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল, "এই তোমরা কারা গো এখানে দাড়িয়ে আছ?"

এনা বলল, আমি এনা আর এ আমার ছোট বোন মিরা। মিরা তো ততক্ষনে মুখ লুকিয়ে ফেলেছে এনার পেটের কাছে আর দুহাত দিয়ে বোন কে জড়িয়ে ধরেছে। পরী মেয়ে টি তার  মাকে ডেকে বলল দেখো মা দুটি ফুটফুটে খুকী। ছোট এনা মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তি জানালো। না না আমি মোটেই খুকি নই। আমি কত্ত বড় হয়ে গেছি, আমার ছোট বোন মিরা এখনো খুকি। পরী বললো তা যাই হোক চল আমরা এখন খেলি। পরীদের হাতে গলায় কানে সব ফুলের গয়না। কি সুন্দর তাদের তাদের রং আর কি সুন্দর গন্ধ। ওরা সবাই নাচছে, গাইছে, হাসছে লুটোপুটি খাচ্ছে। কি হাসি! কি আনন্দ তাদের! শিশু পরি দুটো ঘুমিয়ে পড়ল ফুল গাছের তলায়।

এনা আর মিরা ওদের সাথে খেললো গাইল, নাচলো।

এদিকে রাত গড়িয়ে সকাল হব হব করছে। চাঁদ মধ্য আকাশ থেকে একটু পশ্চিমে হেলেছে। পরীরা বলল চল এবার যাওয়া যাক। সুন্দরী মা পরী জিজ্ঞাসা করলো, 'এনা যাবে নাকি আমাদের সাথে আমাদের দেশে। এনা একটু ইতস্তত করলে মা পরি বলল ভয় কি আমি তো আছি!' মা পরীটা আরো বলল 'তোমাদের কে আমার খুব পছন্দ হযেছে, তাই বললাম। আমরাই নিয়ে যাব সাথে করে আবার সকাল হবার আগে মা জেগে ওঠার আগেই তোমাদের আবার নামিয়ে দিয়ে যাব। তোমাদের মত লক্ষ্মী মেয়ে আর হয়ই না। যাবে তো চল, রাত আবার পেরিয়ে যাচ্ছে।'

এনা মিরার দিকে চাইল। মিরার  দু চোখে ভয়। এনা বোনকে সাহস যোগালো ভয় কি আমি আছি না! সত্যিই তো তাই ওর বোন আছে না! ওর কত সাহস মাকে ছেড়ে স্কুলে যায়। এনা পরীদের বলল 'তবে যাই চল, আমাদের আবার পৌছে দিতে হবে কিন্তু।'

দুটো মা পরী এনা আর মিরার  হাত ধরল।

প্রথমে জোড়া পায়ের দুটো ছোট লাফ এর সাহায্যে একটু উপরে উঠলো। তারপর উড়তে উড়তে দূর আকাশের দিকে উড়ে যেতে থাকলো। নিচে তাকিয়ে এনা দেখল ওদের বাড়ি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। আবছা আবছা দেখতে পাওয়া মসজিদ, মন্দির, পুকুর একসময় এক্কেবারে মিলিয়ে গেল। মিরা জোরসে এনার হাতটা জড়িয়ে ধরল। এনার ও একটু ভয় করছিল বই কি। পরীরা ওকে সাহস যোগালো।

ওরা উড়ছে তো উড়ছেই.. এবার এলো ওরা মেঘের রাজ্যে। পেঁজা তুলোর চাইতেও নরম শীতল সে মেঘগুলো। ওদের মা যখন ওদের কপালে আলতো করে ঠোট ছোঁয়ান ঠিক তেমনি অনুভূতি।  

পরী মা ওদের দুজনকে দু হাতে বসিয়ে নীল তারার দিকে উড়িয়ে নিয়ে চলল। মেঘএর ফাঁকে ফাঁকে ওরা এবার উড়ছে। এবার শুধুই নীল আকাশ। শেষে ওরা পৌছালো পরীদের রাজ্যে। কি সুন্দর! কি সুন্দর! ওদের দু বোনের চোখ ছানা বড়া হয়ে গেল। কি সুন্দর ঘর বাড়ি! পরীদের ঘর গুলো যেন কেমন কাঁচের মত স্বচ্ছ.. ফুল লতা পাতা আকা। একজায়গায় দেখল রংধনু তার সাতটি রং নিয়ে উপস্থিত। বাচ্চা একটা পরী বলল ওটা রাজবাড়ির তোরণ। পেছনেই আছে রাজপ্রাসাদ।

ওরা মা পরীর হাত থেকে নেমে পড়ল। দেখল শিশু পরীরা খেলে বেড়াচ্ছে। তারা প্রজাপতি আর ফড়িং এর সাথে লুকোচুরি খেলছে। হরিন ছানা ঘাস খাচ্ছে নির্ভয়ে। পুকুরে হাঁস চরছে আর পরীরা সাঁতার কাটছে। পরীরা ওদের মধু খেতে দিল পদ্ম পাতায় করে। এনার মন চাইছিল সেও একটু ওদের সাথে খেলা করে কিন্তু মা পরী বলল, 'এবার চল তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।'  ওরা আবার উড়ে চলল।

খুব সকালে সূর্যের প্রথম কিরণ ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই এনা আর মিরার মা বিছানায় উঠে বসলেন। চমকে উঠে লক্ষ্য করলেন এনা আর মিরা বিছানায় নেই। অবশেষে খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল ওদের খুব প্রিয় ফুল গাছের তলায়। হাত ধরা ধরি করে ওরা ঘুমুচ্ছে..